বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় বাদ সাধছেন ভিআইপিরাই

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরের দৃশ্য

দেশের বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারি সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মীদের নিয়েই বিপত্তিতে পড়তে হচ্ছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (বেবিচক)। অভিযোগ রয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিমানবন্দরের নিয়ম না মেনে নিরাপত্তা তল্লাশি ছাড়াই প্রবেশ, শরীর ও ব্যাগ তল্লাশিতে বাধা, অস্ত্র বহনের নিয়ম না মানাসহ নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অসহযোগিতা করেন ভিআইপিরা। বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার অভিযোগও রয়েছে ভিআইপিদের অনেকের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের দায়িত্ব অনুসারে ভিআইপিদের তল্লাশিতে সহযোগিতার অনুরোধ করলে সেটাকেই ‘বেয়াদবি’ এবং ‘অপরাধ’ ধরে নিয়ে তাদের বদলি করানোর জন্য নিজের প্রভাব খাটান বা খাটানোর চেষ্টা করেন অনেক ভিআইপি। বেবিচক ও বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিনতাইচেষ্টা হলে নতুন করে প্রশ্ন ওঠে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে। সে ঘটনার পর দেশের সব বিমানবন্দরে নিরাপত্তা তল্লাশি জোরদার করা হয়। এরপর গত ৫ মার্চ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে প্রবেশের সময় চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের পিস্তল আর গুলি বহনের বিষয়টি ঘোষণা না করা এবং প্রবেশমুখে নিরাপত্তা তল্লাশিতেও অস্ত্র-গুলি ধরা না পড়ায় প্রশ্নবিদ্ধ হয় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রসঙ্গত অস্ত্রসহ বিমানে ভ্রমণের ক্ষেত্রে যাত্রীকে বিমানবন্দরে প্রবেশের সময়েই ঘোষণা দিতে হয়। একইসঙ্গে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ অস্ত্র পরিবহন করে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রভাবশালীরা অস্ত্র বা গুলি বা এরকম কিছু নিয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশ করলেও প্রবেশমুখে এ বিষয়ে ঘোষণা দিতে চান না। অবশ্য, বিশ্বজুড়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় এই দুটি ঘটনার পর সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজন নেতাকে ঘোষণা ছাড়া অস্ত্র নিয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশ করায় মামলা দিয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একাধিক নিরাপত্তাকর্মী জানিয়েছেন, সাধারণ যাত্রীদের নিয়ে আমাদের কোনও সমস্যা হয় না, একটু বুঝিয়ে বললেই নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে সহায়তা করেন। কিন্তু প্রভাবশালীরা সহযোগিতা তো করেনই না, বরং তারাই নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করেন। কেউ কেউ নিরাপত্তাকর্মীদের গালাগাল করেন, শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত করেন। বিমানবন্দরে দলীয় নেতাদের সঙ্গে অনেক কর্মীও ভেতরে প্রবেশ করতে চান। কিন্তু, বাধা দিলেই নানারকমভাবে তারা নিরাপত্তাকর্মীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন।

সরকারি কর্মকর্তাদেরও একটি অংশ বাড়তি সুবিধা দাবি করেন উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নিরাপত্তাকর্মীরা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, সরকারি অনেক কর্মকর্তা আছেন বিধি মোতাবেক তিনি যে সুবিধা পাবেন, তার চেয়ে বেশি সুবিধা দাবি করেন, তখন তাদের সামলানোও কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় তারা প্রভাব খাটিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের বদলির চেষ্টা করেন। অনেকে গায়ে হাত তুলে মারধরও করেছেন।

জানা গেছে, ৩ এপ্রিল রাজশাহী বিমানবন্দরে নিরাপত্তা তল্লাশি এড়িয়ে বিমানে উঠে গিয়েছিলেন রাজশাহী মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার উপকমিশনার (ডিসি) আবু আহাম্মদ আল মামুন। এ নিয়ে বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মীরা আপত্তি তুললে পুলিশের লোকজন বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা শুরু করেন, যা হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়। আপত্তি তোলার অপরাধে সিটি এসবির কনস্টেবল জালাল উদ্দিন বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মীদের গায়ে হাত তোলেন। পরবর্তী সময়ে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা তল্লাশি ছাড়া বিমান ছাড়ার অনুমতি না দেওয়ায় ডিসি মামুন বাধ্য হয়ে বিমান থেকে নেমে নিয়মানুযায়ী তল্লাশি সম্পন্ন করেন।

নিরাপত্তা তল্লাশি

এর আগে ২০১৮ সালের মার্চে তৎকালীন জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীনের ব্যাগ স্ক্যানারে প্রবেশ করালে ধাতব জাতীয় পদার্থ থাকার সংকেত আসে। সেখানে কর্তব্যরত দুই আনসার সদস্য ব্যাগটি খুলে তল্লাশি করার অনুরোধ জানান। তবে সচিব ব্যাগ তল্লাশির অনুমতি না দিয়ে, উত্তেজিত হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিমানবন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন। চাপের মুখে বিমানবন্দরের দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তারা আনসার সদস্য জহিরুল ইসলাম (পরিচয়পত্র নম্বর-১৯১৮৬৬৬) ও সেন্টু রহমানকে (পরিচয়পত্র নম্বর-৬৯০০৩০৮৩৯) তাদের হেফাজতে নেন। পরবর্তী সময়ে দুই আনসার সদস্যকে বিমানবন্দর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

নিরাপত্তা ঝুঁকি প্রসঙ্গে বেবিচকের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, এটা খুব সাধারণভাবেই বলা যায় উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা নিজেরা নিজেদের ব্যাগ গোছান না, এমনকি তারা নিজেরা নিজেদের ব্যাগও সঙ্গে বহন করে আনেন না। গৃহকর্মী বা অন্য কারও সহায়তায় ব্যাগ ‍গুছিয়ে বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয়। এ সময়ের মধ্যে যে কেউ তাদের ব্যাগে ক্ষতিকারক বস্তু দিয়ে দিতে পারে, এমন ঝুঁকি অমূলক নয়। ফলে ভিআইপির নিরাপত্তার স্বার্থেই তার নিজেকেও তল্লাশির মধ্য দিয়ে যাওয়া উচিত। এছাড়া, আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশনসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার নিয়ম অনুসরণ করেই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে আমাদের দেশ থেকে বিমান যাওয়া অথবা আমাদের দেশে বিদেশি বিমান আসা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। আমাদের বিমানবন্দরগুলো ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দর হিসেবে তালিকাভুক্ত হবে।

ওই নিরাপত্তা কর্মকর্তা আরও বলেন, যখন প্রভাবশালীরা নিয়ম ভাঙেন কিংবা নিরাপত্তাকর্মীদের লাঞ্ছিত বা গালাগাল করেন তখন নিরাপত্তাকর্মীটি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে আগ্রহ হারান। কারণ, নিয়ম মেনে দায়িত্ব পালন করায় তাকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। তখন তাদের মধ্যে গাফিলতির প্রবণতা বাড়তে পারে। একইসঙ্গে অনেকেই নিজেকে প্রভাবশালী দাবি করে বিমানবন্দরের নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। আবার, যেহেতু অতীতে প্রভাবশালীদের আক্রোশের শিকার হতে হয়েছিল, তাই আবারও এমন ঘটনার মুখোমুখি হলে নিরাপত্তাকর্মীর মনে অতীতের ভয় থেকে প্রভাবশালীদের ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হতে পারে। এসব কারণেই সবাইকে নিরাপত্তা তল্লাশির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এতে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

এদিকে দেশের বিমানবন্দরগুলোতে সংসদ সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা তল্লাশি শিথিল করার অনুরোধ জানিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। ৭ এপ্রিল এক বৈঠকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা অনুরোধ করেন সংসদ সদস্যসহ ভিআইপিদের জন্য আলাদা সারি করতে। তবে বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এটি বাস্তবায়ন করতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনা প্রয়োজন।

তবে বিমানবন্দরে ভিআইপিদের নিরাপত্তা তল্লাশি শিথিলের অনুরোধ অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক উল্লেখ করে তা অগ্রাহ্য করার আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এটি বাস্তবায়ন হলে তা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে বলেও মন্তব্য টিআইবি’র। ১১ এপ্রিল এক বিবৃতিতে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সংসদ সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য নিরাপত্তা তল্লাশি শিথিল করার অনুরোধের প্রস্তাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সারা বিশ্বেই সিকিউরিটি থ্রেট রয়েছে। আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছি, ১৫-২০ বার বিদেশে বিভিন্ন বিমানবন্দরে আমাকে নিরাপত্তাকর্মীদের তল্লাশির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। জুতা-বেল্ট খুলে তারা তল্লাশি করেছে। একবার আমার সঙ্গে উচ্চপদস্থ এক সেনা কর্মকর্তা ছিলেন, তাকেও নিরাপত্তাকর্মীদের কঠোর তল্লাশির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সিকিউরিটির বিষয়টি সবাইকে বিবেচনায় আনতে হবে। নিরাপত্তার জন্য কেউ সন্দেহের বাইরে নন, আমিও নই।

মো. মাহবুব আলী বলেন, ‘সংসদীয় কমিটি একটি সুপারিশ করেছে। আমরা সেটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানাবো, তারপর সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’