ইউরোপে মানবপাচারে সক্রিয় ১০-১৫টি চক্র

র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন মুফতি মাহমুদ খানলিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে মানবপাচারের সঙ্গে দেশি-বিদেশি ১০-১৫টি চক্র জড়িত বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান। তিনি জানান, সক্রিয় এসব চক্রের মধ্যে পাঁচ-ছয়টি চক্রের মাধ্যমে ইউরোপ যেতে গিয়ে সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরে বাংলাদেশিরা দুর্ঘটনায় পতিত হন। জড়িত এসব চক্রের মধ্যে সক্রিয় দু’টি চক্রের তিন সদস্যকে আটক করা হয়েছে।’

শুক্রবার (১৭ মে) দুপুরে রাজধানীর কাওরানবাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান মুফতি মাহমুদ খান।

আটক তিনজন হলো আক্কাস মাতুব্বর (৩৯), এনামুল হক তালুকদার (৪৬) ও আব্দুর রাজ্জাক ভুঁইয়া (৩৪)।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক বলেন, ‘ইউরোপে কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে প্রথমে লোক সংগ্রহ করে পাচারকারীরা। এরপর গমনেচ্ছুকদের সড়কপথ ও বিমানপথ মিলিয়ে তিনটি রুটে লিবিয়ায় পাঠায়। সর্বশেষ যাদের লিবিয়া থেকে নৌপথে তিউনিসিয়ার উপকূল হয়ে ইউরোপে পাঠানো হয়, তাদের কাছ থেকে ৭-৮ লাখ টাকা নেওয়া হয়। চক্রের সদস্যরা পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দুই মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় নেয়। ইউরোপে যাওয়ার আগেই অধিকাংশ টাকা পরিশোধ করতে হয় বলে ভুক্তভোগীরা পাচারকারীচক্রের ফাঁদে পড়ে যান। এর ফলে ইচ্ছা থাকলেও তারা আর সিদ্ধান্ত পাল্টাতে পারেন না।’

মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘আটক তিনজনের কাছ থেকে জেনেছি, তারা প্রথমে বিদেশ গমনেচ্ছুকদের নির্বাচন করে এবং পরের ধাপে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া পাঠায়। এই সময়ের মধ্যে চক্রের সদস্যরা দফায় দফায় টাকা হাতিয়ে নেয়। সর্বশেষ যাদের ইউরোপে পাঠানো হয়, চুক্তির অধিকাংশ টাকা আগেই পরিশোধ করতে হয় তাদের।’

তিনি বলেন, ‘ভুক্তভোগীদের পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকিট ক্রয় এই সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়। ইউরোপে পৌঁছে দিতে যে সাত-আট লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়, তার মধ্যে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা লিবিয়ায় পৌঁছানোর আগে এবং বাকি টাকা লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাত্রার আগে পরিশোধ করতে হয়।’

পাচারকারী চক্রের তিন সদস্য

মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘ইউরোপে যেতে ব্যবহৃত তিনটি রুট হলো—বাংলাদেশ-ইস্তাম্বুল (তুরস্ক)-লিবিয়া, বাংলাদেশ-ভারত-শ্রীলংকা (৪-৫ দিন অবস্থান)-ইস্তাম্বুল (ট্রানজিট)-লিবিয়া এবং বাংলাদেশ-দুবাই (৭-৮ দিন অবস্থান)-আম্মান (জর্ডান)-বেনগাজী (লিবিয়া)-ত্রিপলি (লিবিয়া)। এ ক্ষেত্রে তারা সড়ক পথ ও বিমানপথ ব্যবহার করে লিবিয়ায় নিয়ে যায়।’

তিনি বলেন,“সম্প্রতি ভুক্তভোগীরা ত্রিপলিতে পৌঁছানোর পর, সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি কথিত ‘গুডলাক ভাই’সহ আরও কয়েকজন এজেন্ট তাদের রিসিভ করে। তাদের ত্রিপলিতে বেশ কয়েকদিন রাখা হয়। এ সময়ে ভুক্তভোগীদের স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়।
এই র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, ‘সেখানকার সিন্ডিকেট সমুদ্রপথ অতিক্রম করার জন্য নৌযান চালনা ও দিকনির্ণয়যন্ত্র পরিচালনাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ের ওপর নানাবিধ প্রশিক্ষণ দেয়। একটি নির্দিষ্ট দিনে ভোরে একসঙ্গে কয়েকটি নৌযান লিবিয়া থেকে তিউনেসিয়া উপকূলীয় চ্যানেল হয়ে ইউরোপের পথে রওনা দেয়। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথে যাওয়ার সময় ভুক্তভোগীরা ভূমধ্যসাগরে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হন।’

মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘গত ৯ মে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ বাংলাদেশীরা সিলেট, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, কিশোরগঞ্জ ও নোয়াখালীর বাসিন্দা। তারা পাঁচ-ছয়টি চক্রের মাধ্যমে ইউরোপে যাচ্ছিলেন। ওই চালানে কতজন সেখানে গিয়েছিলেন বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। পাচারকারীচক্রের আটক তিন সদস্যকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। এছাড়া দেশজুড়ে আরও যে চক্রের খবর আমরা পেয়েছি, তাদের আইনের আওতায় আনতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’

উল্লেখ্য, গত ৯ মে ইউরোপে অভিবাসী প্রত্যাশীদের নিয়ে লিবিয়া থেকে যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে যায়। এতে অন্তত ৩৭ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। জীবিত উদ্ধার করা হয় ১৪ জনকে। নিখোঁজ রয়েছেন এখনও অনেকে।