চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র এলাকার একটি গ্রাম টিকোইল। গ্রামটি স্থানীয় পরিসরে আলপনা গ্রাম নামেই পরিচিত। মাটির তৈরি ঘরে যুগের পর যুগ ধরে নারীরা আলপনা এঁকে চলেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— নানা রকম মাটি দিয়ে নানা রকম রঙ এবং প্রাকৃতিকভাবে গাছ-লতা থেকে আঠা তৈরি করে তারা মাটির ঘরে আলপনার কাজটি করে থাকেন। বাংলা ট্রিবিউনের চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন সরেজমিনে সেখানে গেলে গ্রামবাসী জানান, কোনও আলাপ-আলোচনা ছাড়া হুট করেই এই গ্রামে শুটিং ইউনিট আসে। দুদিন ধরে এখানকার একটি বাসায় তাদের সঙ্গে থেকে কীসব করেছেন শুটিংয়ের লোকজন। তারা জানেনও না তাদের কীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কেননা, ওই দুদিনের পর আর তাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগও করেনি। শুটিং শেষে তাদের কয়েকটি পরিবারের সদস্যদের হাতে বার্জারের ডিব্বা দেওয়া হয়।
যে বাসায় শুটিং হয়েছিল সেই বাসার সদস্য বেখন বর্মণ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, হুট করে শহর থেকে এরা এসে শুটিং করে। বাসার যে অংশ তাদের সার্বক্ষণিক দরকার হয়, সে অংশটি শুটিংয়ের লোকেরা রঙ করে নেয়।
দেখন বালা বর্মণ বলেন, ‘বার্জার কোম্পানির লোকজন এসেছিল। তারা আমাদের সঙ্গে এই আলপনার বিষয়ে কথা বলেছেন। বার্জার পেইন্ট বেশি স্থায়িত্ব এসব বলেছেন। দুদিন পর ওরা শুটিং করে চলে গেছেন। যাওয়ার সময় দুটো করে রঙর ডিব্বা দিয়ে গেছেন। আর কোনও যোগাযোগ হয়নি।’ এ ধরনের বিজ্ঞাপন বানানো হয়েছে জানেন কিনা প্রশ্নে তিনি নেতিবাচক জবাব দেন। ভিডিওতে রঙের স্থায়িত্ব নিয়ে যে দাবি করা হয়েছে, সে বিষয়ে দেখন বালা বলেন, ‘বার্জার দিয়ে কখনও একাধিকবার মাটির দেয়ালে রঙ করা যাবে না। কেননা, একাধিকবার ব্যবহারে এটি পুরু হয়ে মাটির দেয়ালটাকেই নষ্ট করে দেবে।’
আর মোবাইল সেটের বিজ্ঞাপনে পাহাড়ের একটি প্রত্যন্ত এলাকা দেখানো হয়েছে। ৩ মিনিট ৮ সেকেন্ডের এই বিজ্ঞাপনের ফিল্মে দেখানো হয়— রমজানে সেহরি ও ইফতারের সময় জানার কোনও ব্যবস্থা না থাকায় একজন পাহাড়ি ছেলে দোকানে আজান শুনে দৌড়ে দৌড়ে পুরো পাড়ার সবাইকে জাগায়। সেখানে একজন জেগে উঠে বের হয়ে এসে তাকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘আমি হিন্দু।’ আর সেই পাহাড়ি ছেলেটির বাঙালি নাম রাফি। অনেক অসঙ্গতিতে ভরা এই ফিল্মকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলে চিহ্নিত করে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী ইলিরা দেওয়ান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফিল্মটির বিষয়বস্তু সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তো অবশ্যই। নামাজ পড়ার দৃশ্য দিয়ে ধর্মীয়ভাবে একটা অপব্যাখ্যা/ ভুলবার্তা সাধারণের মাঝে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, ইফতার-সেহরি হবে। এর সঙ্গে মন্দির ও প্যাগোডায় ভোর ও সন্ধ্যা বেলায় যে বন্দনা করা হয়, সেটাও তুলে ধরে বাংলাদেশ যে সম্প্রীতির দেশ, তা তুলে ধরা যেত। পাহাড়ের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি যে দিন দিন ইসলামিক আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে, সেই প্রকৃত চিত্রই এখানে উঠে এসেছে। এর মাধ্যমে পাহাড়ের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে স্বাভাবিকীকরণ করার আরেক অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।’
তিনি বলেন, ‘একেকটা ইস্যুর কনটেক্সট থাকে। পাহাড়ের আর যে ইস্যু আছে, সেগুলো এখানে ধরতে চেষ্টা করা হয়নি। জনাকীর্ণ একটি এলাকা, যেখানে ছোট মুসলিম কমিউনিটি আছে এবং আজানের ধ্বনি শোনা যায় না— সেখানে একজন ছেলে রাফি, যেটি তার আসল নাম না, সে সবাইকে সঠিক সময়টা জানানোর মধ্য দিয়ে একটি পরিবার খুঁজে পায়। আমরা এই সুইট জিনিসটা তুলে ধরতে চেয়েছি। অন্য কোনও উদ্দেশ্য আমাদের ছিল না।’
অ্যাক্টিভিস্ট বাকী বিল্লাহ বিজ্ঞাপনের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, ‘বিজ্ঞাপন নির্মাতা ঐতিহ্যের পরম্পরা সম্পর্কে বয়ান দিচ্ছেন, মাটি দিয়ে প্রাকৃতিক রঙ তৈরির কলাকৌশল দেখাচ্ছেন, অথচ সবকিছু দেখিয়ে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, প্রাকৃতিক রঙ বড়ই ক্ষণস্থায়ী। এ রঙ কিছু দিন পরপর মুছে যায়। কষ্ট করে আবারও তাদের রঙ করতে হয়। সেখানে দেবদূতের মতো রঙের ডিব্বা নিয়ে হাজির হচ্ছে বার্জার।’
নৃবিজ্ঞানী সিঁউতি সবুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের দেশের বিজ্ঞাপন নির্মাতারা জনবিচ্ছিন্ন এবং ইতিহাসবিমুখ। তারা প্রভাবশালী জনগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠিত ভাবনাকেই প্রচার করতে চান। ফলে এ ধরনের অবান্তর বিজ্ঞাপন সৃষ্টি হয়। পাহাড়িদের সম্পর্কে তাদের যেমন ধারণা নেই, তেমনই পুরনো ঢাকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়েও তাদের ধারণা নেই। এক অর্থে এদেরকে ইতিহাস বিচ্যুতও বলা যায়।’
দুটি ফিল্মের (বিজ্ঞাপন) বিষয়ে নুহাশ হুমায়ূনের বক্তব্য জানতে তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এরপর তাকে মেসেজ পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি কোনও উত্তর দেননি।