উইলস লিটলে শিক্ষার্থীরা বছরে বিদ্যুৎ-জেনারেটর ফি গুনছে ৫৪ লাখ টাকা!

উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজরাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজে এক বছরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ ও জেনারেটর ফি বাবদ আদায় করা হয় ৫৪ লাখ টাকারও বেশি। অথচ এই দুই খাতে বছরে খরচ হয় ২০ লাখ টাকারও কম। অতিরিক্ত আদায় করা ৩৪ লাখেরও বেশি টাকা ভাগাভাগি করে নেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ আছে— উইলস লিটলে সরকার নির্ধারিত চারটি খাত ছাড়া প্রায় প্রতিটি খাতেই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়। যদিও প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ বলছে— বিদ্যুৎ ও জেনারেটর বাবদ প্রচুর অর্থ খরচ হয়। খরচের বেশি টাকা নেওয়া হয় না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবছর প্রি-প্রাইমারি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৯ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে, যা বিগত বছরের চেয়ে কম। এবার প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বিদ্যুতের জন্য ৩০০ ও জেনারেটর বাবদ ৩০০ টাকা করে ৯ হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে মোট ৫৪ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ ও জেনারেটর খাত ছাড়াও এই প্রতিষ্ঠানটিতে অন্যান্য খাতেও অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়, অভিভাবক মহলে এমন অভিযোগ আছে। জানা গেছে, এবছর ‘উইলস বার্ষিকী’র জন্য ২৭ লাখ, বার্ষিক পুরস্কারের জন্য ১৮ লাখ, জাতীয় দিবস ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রায় ১০ লাখ এবং মিলাদ মাহফিলের জন্য  আদায় করা হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকা।

এছাড়া, কোনও শিক্ষার্থীর অভিভাবক যদি নির্ধারিত সময়ে   টিউশন ফি দিতে না পারেন, তাহলে ১০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। আবার জরিমানার টাকাসহ নির্ধারিত সময়ে কেউ টিউশন ফি পরিশোধ করতে না পারলে পুনরায় ভর্তির নামে আদায় করা হয় এক হাজার ৫০০ টাকা। প্রি-পাইমারির শিশুদের কাছ থেকেও এবছর একই হারে টাকা আদায় করা হয়েছে।

অভিভাবক দেবব্রত দত্ত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বড় বড় ক্লাস রুমে চারটির বেশি ফ্যান নেই। শিশুরা গরমে কষ্ট করে। ক্লাস রুমে এসি নেই, কিন্তু বিদ্যুৎ বিলের জন্য জনপ্রতি বছরে ৩০০ টাকা আদায় করা হয়। খরচের পর যে টাকা বাঁচে, তা ভাগাভাগি করে নেন শিক্ষকরা। নির্ধারিত সময়ে টাকা পরিশোধ করতে না পারায় ১০০ টাকা করে জরিমানা এবং দেড় হাজার টাকা রি-অ্যাডমিশন ফি আদায় করা হয়। অথচ পুনরায় ভর্তি ফি নেওয়ার কোনও বিধান নেই।’

আরেক অভিভাবক সেবিকা রানী বলেন, ‘আমার ছেলে পড়তো উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে। অতিরিক্ত অর্থ আদায়, কিছু শিক্ষকের অসভ্য ব্যবহার, বড় ক্লাস রুমে কম ফ্যানসহ নানা অনিয়মের কারণে ছেলেকে ওই স্কুল থেকে সরিয়ে অন্যত্র ভর্তি করিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ বন্ধ থাকলে নির্ধারিত কিছু লাইট ও ফ্যান চলে জেনারেটর দিয়ে, তখন বেশিরভাগ রুমের ফ্যানই চলে না। বরং বছরের বেশিরভাগ সময় জেনারেটর পড়ে  থাকে। কিন্তু বিদ্যুৎ ফি’র পাশাপাশি জেনারেটর খাতেও সমান টাকা নেওয়া হয়। শুধ এবছরই নয়, প্রতিবছরই এভাবে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে আসছে এই প্রতিষ্ঠানটি।’

অর্থ আদায়ের বিষয়টি স্বীকার করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. আবুল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পরিচালনা পর্ষদের নির্ধারিত অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে আদায় করা হয়। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকা সংশ্লিষ্ট খাতেই ব্যয় হয়, অন্যকোনও খাতে ব্যয় হয় না।’  তিনি দাবি করেন, ‘বিদ্যুৎ ও জেনারেটর বাবদ প্রচুর অর্থ খরচ হয়। খরচের বেশি টাকা নেওয়া হয় না।’

 

বিদ্যুৎ ফি ২৭ লাখ টাকা

বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ থেকে জানা গেছে, উইলস লিটল স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রতিমাসে বিদ্যুৎ বিল হয় গড়ে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা। সেই হিসাবে এক বছরে বিদ্যুৎ বিল বাবদ প্রতিষ্ঠানটি খরচ করে ১৫ লাখ। অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বৈদ্যুতিক অন্যান্য সরঞ্জামের জন্য বছরে এক লাখ টাকাও খরচ নেই। কোনও কোনও বছর তেমন খরচই হয় না। গড়ে বছরে ১৬ লাখেরও কম টাকা এই খাতে খরচ হয়। অথচ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বছরে ১১ লাখ টাকা বেশি আদায় করা হচ্ছে।

জেনারেটর ফি ২৭ লাখ টাকা

একইভাবে ৩০০ টাকা করে ৯ হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে জেনারেটর ফি বাবদ বছরে আদায় করা হয় ২৭ লাখের বেশি টাকা। অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদ্যুতের তেমন লোড শেডিং নেই। সে কারণে জেনারেটর চালানোর দরকার হয় না।  এই টাকা কর্তৃপক্ষ কীভাবে খরচ করে, তা কারও জানা নেই। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় দ্রুত বন্ধ করা প্রয়োজন।

উইলস বার্ষিকী ফি ২৭ লাখ  

উইলস বার্ষিকী বাবদ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৩০০ টাকা করে নেওয়া হয়। এখাতেও মোট আদায় হয় ২৭ লাখ টাকারও বেশি। জানা যায়, উইলস লিটলে বছরে মাত্র একবারই বার্ষিকী প্রকাশ করা হয়। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দাবি— এই বার্ষিকী ছাপাতে খরচ হয় পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা। বাকি টাকা  ভাগ করে নেওয়া হয়।

জাতীয় দিবস,বার্ষিক পুরস্কার ও মিলাদ-মহফিল

উইলস লিটল স্কুল অ্যান্ড কলেজেবার্ষিক পুরস্কারের জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ২০০ টাকা  করে মোট আদায় হয় প্রায় ১৮ লাখ টাকা। জাতীয় দিবস ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য জনপ্রতি ১০০ টাকা করে বছরে মোট ৯ লাখ আদায় হয়। এছাড়া, মিলাদ-মাহফিলের জন্যও বছরে আদায় করা হয় আরও  প্রায় ১০ লাখ টাকা।

উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে ভর্তির রশিদ

 

উইলস লিটলে খাত ওয়ারি বিভিন্ন ফি

প্রথম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর ভর্তির রশিদে দেখা গেছে— টিউশন ফি এক হাজার ৫০০, আইটি ফি ৩০, স্পোর্টস ফি ১০০, বিদ্যুৎ ফি ৩০০, বিদ্যুৎ না থাকাকালীন সময়ে জেনারেটর ফি বাবদ ৩০০, পানির ফি ১২০, উইলস বার্ষিকী ১০০, সিলেবাস ১০০, মার্ক শিট ১০০, নিজস্ব ব্যবস্থায়পনায় কাগজের তৈরি ফিস বুক (Fees Book) চার্জ ৫০, মিলাদ-মাহফিল ১০০, জাতীয় দিবস ও সাংস্কৃতি কর্মকাণ্ডের জন্য ১০০, দরিদ্র তহবিল ১০০, বার্ষিক পুরস্কারের জন্য ১০০, লাইব্রেরি ফি ১০০, ল্যাবরেটরি ফি ১০০, স্কাউট ফি ৫০, ইয়োথ রেডক্রস ২০, প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ডোনেশন ১০০ ও বিবিধ ৩০০ টাকা।

বিদ্যালয়ে বেলুন বিক্রি

অভিভাবকরা জানিয়েছেন, উইলস লিটলের ক্যাম্পাসে খাতা-কলম বিক্রির দোকান আছে। সেখানে প্রতিটি খাতা বাজারের চেয়ে ১০ থেকে ২০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করা হয়। বিদ্যালয়ের ভেতরে স্টিকার বেলুন ও খেলনার দোকানও রয়েছে। এই দোকনে পাঁচ টাকার স্টিকার বিক্রি হয় ১০ টাকায়। আর সাত টাকার রঙিন বেলুন বিক্রি হয় ২০ টাকায়।

অভিভাবক দেবব্রত দত্ত বলেন, ‘স্টিকার বেলুনসহ খেলার জিনিসপত্র কেন রাখা হয়েছে তা বোধগম্য নয়। তারপরেও প্রতিটি জিনিসের দাম দ্বিগুণ। প্রতিবাদ করতে পারি না, স্কুলে আমার সন্তান সমস্যায় পড়বে এই ভয়ে।’

আরও অভিযোগ

২০১৭ সালে শিক্ষার্থীদের কাছ ভর্তি বাবদ সরকার নির্ধারিত ফি’র চেয়ে বেশি ফি আদায় করে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এজন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ রাজধানীর ১৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়। পরে উইলস লিটলসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভর্তি ফি’র অতিরিক্ত টাকা ফেরত দেয়।

অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ উইলস লিটলের বিরুদ্ধে কোচিং বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে। কোচিং বাণিজ্য বন্ধে ১১১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অফিদফতরে পাঠিয়েছে দুদক। সূত্র জানায় এরমধ্যে উইলস লিটলের নামও আছে।