বন্যার্তদের জন্য একদল তরুণের ‘কোরবানি’

korbani-5কোরবানি মানে ত্যাগের মাধ্যমে নিজের মনের পশুকে মেরে ফেলা। এই ত্যাগের অনেক উদাহরণ পৃথিবীতে আছে। তবে একদল তরুণ এই ত্যাগের দৃষ্টান্ত অন্যভাবে তৈরি করতে আগ্রহী। তাই ঈদের খুশি, পরিবারের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি ত্যাগ করে তারা উদ্যোগ নিয়েছেন উত্তরাঞ্চলের বন্যাপীড়িত পাঁচটি গ্রামে কোরবানির মাংস পৌঁছে দেওয়ার। আর এই উদ্যোগে প্রথমবারের মতো সঙ্গী হয়েছেন ফেসবুক সেলিব্রিটি খ্যাত ‘কনসেপ্টোলজিস্ট’ আরিফ আর হোসেন। তার আহ্বানে জোগাড় হয়েছে এই পাঁচটি গ্রামে বিতরণ করার জন্য ১৩টি গরু এবং একটি ছাগল কেনার অনুদানের টাকা। আর এই কাজের তদারকিও করছেন তিনি নিজে। তার সঙ্গে শরিক হয়েছেন ৯১ জন।
ফোরাম এসডিএ (ফোরাম ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস) সংগঠনের কিছু স্বপ্নবাজ তরুণ ২০১৩ সাল থেকে কোরবানি ঈদের তৃতীয় দিনে সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের মাঝে ঈদের মাংস ও খাবার বিতরণের মাধ্যমে তাদের এই কার্যক্রম শুরু করে। ২০১৩ সালে ঢাকায় স্বল্প পরিসরে বিভিন্ন জায়গার পথশিশুদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হয়। ২০১৪ সালে নিজেরাই মাংস সংগ্রহ করে সিরাজগঞ্জের দুখিয়াবাড়ি বন্যাকবলিত গ্রামের প্রায় ১ হাজার ২০০ বাসিন্দার মধ্যে বিতরণ করে সংগঠনটির সদস্যরা।korbani-1
ফোরামের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি গ্রামে বিতরণ করা হবে কোরবানির মাংস। গ্রামগুলো হলো- কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা টোনগাম, লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেলার শোলমারি, গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কাইয়ারহাট, সিরাজগঞ্জের কাওয়াখালি এবং বগুড়ার সারিয়াকান্দি।
তাদের এই উদ্যোগকে সহযোগিতা করার অংশ হিসেবে ১ আগস্ট ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ আর হোসেন একটি পোস্ট লেখেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘একটা অংক বলি;বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ কোটির কিছু বেশি পশু কোরবানি হয় (তথ্য: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়)। তার মানে, ১৭ কোটির দেশে প্রায় ৬ শতাংশ মানুষ কোরবানি দেয়। ঢাকায় থাকে প্রায় ২ কোটি মানুষ, এরমধ্যে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ এই ঈদে ঢাকা ছাড়ছে (তথ্য: বাংলা ট্রিবিউন)। এই ঈদে তাহলে ঢাকায় থাকছে ৯০ লাখ মানুষ। ৯০ লাখের মাঝে ৬ শতাংশ কোরবানি দিলে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ পশু কোরবানি হবে এবার শুধু ঢাকাতেই। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই কোরবানির ১ তৃতীয়াংশ মাংস যাওয়া উচিত গরিবদের কাছে। তার মানে প্রায় পৌনে দুই লাখ পশুই গরিবের প্রাপ্য।korbani-3
আরিফ আর হোসেন আরও বলেন, ‘এখন বলি, এই গরিবের ভাগের মাংস কারা পায়; আমার বাসার বুয়া, ক্লিনার, দারোয়ান, কেয়ারটেকার, বুয়ার ভাই, দারোয়ানের বোন কেয়ারটেকারের ফ্যামিলি আর আমার বাসার নিচে কোনও ভিক্ষুক এলে তারা নেয়। আপনি কি জানেন প্রতি কোরবানি ঈদের রাতেই গরুর মাংস বিক্রি হয় মহল্লায় মহল্লায়? আমাদের বুয়া ড্রাইভাররাই বিক্রি করে এসব। একজনের দরকার পাঁচ কেজি। কিন্তু, দেখা যায়, পেয়েছে ২৫-৩০ কেজি। কী আর করবে, বিক্রি করে দেয়। এই কোরবানি ঈদে মাংস বাণিজ্য এমন একপর্যায়ে গেছে যে, গাজীপুর, জামালপুর থেকে মানুষ শুধু এই ঈদে ঢাকায় আসে এই গরিবের মাংস বাণিজ্য করতে, আমি জানতে পারলাম, কারণ আমার ড্রাইভার একই কাজ করে। গাণিতিক আলাপ শেষ, এখন আসল আলাপ; যখন লেখাটা লিখছি, তখন বাংলাদেশের ২২টা জেলার প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত। সৌদিআরব প্রতিবছর তাদের কোরবানির অতিরিক্ত মাংস যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গরিব দেশগুলোতে পাঠাতে পারলে, আমরা আজকে ঢাকা থেকে মাংস আমাদের উত্তরাঞ্চলের যে এলাকাগুলোতে খুব দরকার সেখানে কেন পাঠাতে পারবো না? আমরা একটা টিম রেডি করেছি, যারা রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জের একদম বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলে গিয়ে মাংস বিতরণ করে আসবে। সমস্যা হলো, ঢাকা থেকে টনকে টন মাংস নিয়ে সেখানে যাওয়াটাই সমস্যা। পরে ঠিক করা হলো, আমরা সেসব অঞ্চলে গিয়ে, সেখান থেকে গরু কিনে কোরবানি করবো। কনসেপ্ট কিন্তু সিম্পল; আপনি প্রতি বছর ঢাকায় ৩ ভাগ দেন? এ বছর না হয় ২ ভাগ দেন ঢাকায় আর ১ ভাগের টাকা আমাদের দিন। আমরা আপনার মতো এরকম ৭ জনকে পেলেই একটা গরু কিনে ফেলবো। আমি স্ট্যাটাস লেখার আগেই ফোনে ফোনে ৪ টা গরু জোগাড় করে ফেলেছি। ৪ টা গরু মানে ২৮ জন শরিক আমি ফোনেই পেয়ে গেছি, যারা বন্যা কবলিতদের জন্য ১ ভাগ করে দেবে। এখন দেখি স্ট্যাটাস থেকে কয়টা গরু উঠে!
এফডিএ ফোরামের সভাপতি এম এম রায়হান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গতবার আমরা তিনটি গরু জোগাড় করতে পেরেছিলাম। আরিফ ভাই এবার আমাদের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্ট্যাটাস দেওয়ার পর ১৩টি গরু এবং একটি ছাগল জোগাড় হয়েছে। আমরা প্রতিটি গ্রামের জন্য ২০ জন সদস্যের একটি টিমসহ প্রায় ১০০ জনের বেশি স্বেচ্ছাসেবী তৈরি করেছি এই কাজের জন্য।’
ফোরামের পক্ষ থেকে আয়োজনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ত্যাগের উৎসব।’ ফোরামটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা এই আয়োজন শুরু করেছিল মাংস নিয়ে রান্না করে খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে। মাংস পরিবহন অনেক ঝামেলা ও সংরক্ষণ করাও কঠিন। ঢাকায় সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক মাংস পায় এবং রাতে বিক্রি করে দেয়। কিন্তু, বানবাসী বা দূরের সুবিধাবঞ্চিত গ্রামের মানুষ সহজে মাংস সংগ্রহ করতে পারে না। তাই মানুষের কোরবানির মাংস উপযুক্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াই তাদের লক্ষ্য।korbani-4
রায়হান আরও বলেন, ‘আমরা নিজেরাই গরু কিনি, টোকেন বিতরণ করি, টোকেনের মাধ্যমে মাংস বিতরণ করি। এতে আমাদের স্থানীয় টিম আমাদের সহযোগিতা করে। আমরা ঈদের তৃতীয় দিন কোরবানির ব্যবস্থা করেছি। এর কারণ হলো- আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা চট্টগ্রামসহ দূর-দূরান্ত থেকে এই কাজে এসে অংশ নেবে। ঈদে তো পরিবারকেও সময় দিতে হয়, তাই সব মিলিয়ে ঈদের তৃতীয় দিন বুধবার (১৪ আগস্ট) আমরা কোরবানির কাজ করবো।
আরিফ আর হোসেন নিজের পোস্টে আরও উল্লেখ করেন, এই টিমের কারোরই ইচ্ছে নেই গরুর মাংস মেরে খাওয়ার। এই টিমের কারোরই ঠেকা পড়েনি ঈদে ঢাকার আরাম-আয়েশের বিছানা ছেড়ে বন্যাকবলিত অঞ্চলে গরমের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করে মাংস বিতরণ করার। এরা যারা প্রত্যেকেই কাজটা করছে,দায়িত্ববোধের তাগিদে। হেল্প না করতে পারলে,অন্তত দোয়া করে দিন এদের জন্য।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আরিফ আর হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমি আসলে চেষ্টা করি যারা সমাজে ভালো কাজ করছে তাদেরকে একটু সুযোগ করে দিতে, যেহেতু ফেসবুকে আমার একটি মোটামুটি অবস্থান আছে। আমি চেষ্টা করি যে কারও ভালো কাজের পার্টনার হওয়ার। যখন দেখি কেউ কোনও ভালো কাজ করছে, আমি চেষ্টা করি তাদেরকে একটু প্রমোট করে দেওয়ার জন্য। প্রমোট করে বসে থাকি না, কারণ যদি এর সঙ্গে আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকে মানুষ আমাকে বিশ্বাস করেই কিন্তু সাহায্যটি করবে। এর মধ্যে যদি স্বচ্ছতা না থাকে, পরবর্তীতে আমার বদনাম হবে। আমি যাদেরকেই প্রমোট করার চেষ্টা করি, আগে তাদের সঙ্গে বসি, তাদের অর্গানোগ্রাম দেখি, আরও কিছুটা গুছিয়ে দেই, ফান্ড কীভাবে নিতে হবে সেটি দেখিয়ে দেই। ফান্ড আসার পর কত টাকা কিভাবে খরচ হলো সেটার হিসেব রাখি।korbani-2
তিনি আরও বলেন, যাই করছি কোনোটাই আসলে আমার নিজের উদ্যোগ না। যারা ভালো কাজ করে তারা কীভাবে যেন আমাকে খুঁজে পায়, আবার আমিও কীভাবে যেন তাদেরকে খুঁজে পাই। তাদেরকে আমি শুধুমাত্র তুলে ধরি। এই বন্যার্তদের নিয়ে যেটা করা হচ্ছে সেটা তেমন একটি কাজ। আমি নিজেও বুঝিনি এমন সাড়া পাওয়া যাবে। আমি যখন স্ট্যাটাস দেই, অভাবনীয় সাড়া পেয়েছি। এমনও হয়েছে যে- যারা প্রতি বছর বড় সাইজের একটি গরু দেয়, তারা আমাদেরকে একটি আস্ত গরু দিয়ে দিয়েছে। আমি বর্তমানে দেশে নেই, থাকলে আমি তাদের সঙ্গে উত্তরবঙ্গে গিয়ে সেখানে থেকে কাজগুলো দেখতাম। তবে বাইরে থাকলেও তাদের সঙ্গে আমার প্রতিনিয়ত যোগাযোগ আছে, কী করছে না করছে সব খোঁজ রাখছি।