‘যেখানে উচ্চশিক্ষাই নেই সেখানে মান আসবে কোত্থেকে’

‘উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা’ শীর্ষক বৈঠকিতে আলোচকরা‘বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নয়, “মধ্যশিক্ষা” দেওয়া হয়। যেখানে উচ্চশিক্ষাই নেই সেখানে সেটির মান আসবে কোত্থেকে?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাবে) অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। দেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের আয়োজনে ‘উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা’ শীর্ষক বৈঠকিতে এই প্রশ্ন তোলেন তিনি। সাংবাদিক মুন্নী সাহার সঞ্চালনায় মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) বিকালে বাংলা ট্রিবিউন স্টুডিওতে আয়োজিত হয় এই বৈঠকি।

উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘ইউজিসি কোনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চশিক্ষা দেওয়ার অধিকার দেয়নি। সেখানে শুধু পেশাগত শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এগুলোকে আমরা ভালোবেসে উচ্চশিক্ষা বলি।’

সলিমুল্লাহ খানএ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে পাঁচ বছরের শিক্ষাকে প্রাথমিক শিক্ষা বলা হয়। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, আপনি যদি ১২ বছর স্কুলে কাটান, এটাকে বলা হয় বুনায়াদি শিক্ষা। আমরা এটাকে নানা ভাগে ভাগ করেছি; যেমন– নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক। এক হিসাবে সবকটিই প্রাথমিক শিক্ষা। এরপর শুরু হয় পেশাগত শিক্ষা। তারপর উচ্চশিক্ষা। আমরা ডাক্তার হই, ইঞ্জিনিয়ার হই! আমরা বৃথাই এটাকে উচ্চশিক্ষা বলি।’

সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘আমি বলবো, বাংলাদেশের বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চশিক্ষার মান পড়ে গেছে। তার কারণ– আমরা এমএ পাস করার পর উচ্চশিক্ষা বলতে মনে করি এমফিল। পিএইচডি করতে সুযোগ পেলেই বিদেশে যেতে চাই। আর কোথাও না পারলে পাসের দেশ ভারতে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা দেশ হিসেবে ডিগ্রির একটি অলিখিত স্তর তৈরি করি। বিশ্বব্যাংক সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর অদ্ভুত মান চাপিয়ে দিচ্ছে উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের (হেকেপ) আওতায়। সত্যি কথা হলো– মধ্যশিক্ষার মান উন্নয়নে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা কী? অনেক ভালো ভূমিকা আমরা পালন করছি। আমি এটাকে উচ্চশিক্ষা বলবো না। কারণ ইউজিসি আমাদেরকে এমফিল করার অনুমতি দিচ্ছে না। অথচ আমরা (ইউল্যাব) ১৪-১৫টি সেন্টার চালাই, যেগুলো প্রথম শ্রেণির গবেষণা করে। আমরা এমফিল, পিএইচডি করাতে পারতাম কিন্তু আমাদের ওপর তাদের আস্থা নেই।’ 

ড. গোলাম সামদানি ফকিরবেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রিন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সামদানি ফকির বলেন, ‘উচ্চশিক্ষা মানুষকে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার জন্য তৈরি করে। যারা উচ্চশিক্ষা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, তারা কি সক্ষমতা অর্জন করতে পারছে? সেটা কিন্তু একজনের স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সমস্যার সমাধানের জন্য তারা এগিয়ে আসছে কিনা, সেই জিনিসগুলো একধরনের মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা যায়।’ 

এ সময় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে যাই, তাহলে কতকগুলো বিষয়ে আমাদের ফোকাস করা দরকার। আমরা যে ধরনের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে চাচ্ছি, তাদেরকে তৈরি করার জন্য ইউনিভার্সিটিতে যারা আসছে, তাদের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিতে হবে। এটা ঠিক করতে প্রথমেই আসে আমার ফ্যাকাল্টি। আমরা ধরে নিচ্ছি, যেসব শিক্ষার্থী ক্লাসে প্রথম হবেন তারাই শিক্ষক হবেন। তাহলে বিষয়টা কেমন দাঁড়ালো! আমরা প্রাইমারি স্কুলের টিচারদের ট্রেনিং দেওয়ার জন্য ইনস্টিটিউট করেছি। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে পড়াবার জন্য কোনও ট্রেনিং দরকার নেই– এটি কি ঠিক?’

মোহাম্মদ তারেক রহমানইউল্যাবের জেনারেল এডুকেশন বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর টিচিং অ্যান্ড লার্নিংয়ের (সিইটিএল) পরিচালক মোহাম্মদ তারেক রহমান বলেন, ‘উচ্চশিক্ষায় মানের যে জায়গায় আমরা যেতে চাচ্ছি, এখনও সেখানে পৌঁছাতে পারিনি। তার মানে এও না যে আমরা তলানিতে পড়ে আছি। আমাদের কিছু ভালো দিক আছে, আমরা এগুচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কী ভূমিকা রাখছে তা নিয়ে আমি যতোটুকু জানি দেশে-বিদেশে গবেষণা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যে সমসাময়িক বিষয়গুলো জড়িত, সেগুলোর মধ্যে এক ধরনের মেলবন্ধন করে উচ্চশিক্ষাকে কীভাবে দেখা যায় এবং এর মান উন্নয়নে কী ধরনের নিয়ামকের প্রয়োজন হবে সেগুলো নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।’

শেখ নাহিদ নিয়াজীস্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান শেখ নাহিদ নিয়াজী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আন্তর্জাতিক রেটিং আছে সেটা এক ধরনের স্ট্যান্ডার্ড। টাইমস হায়ার এডুকেশন সহ অনেক রেটিংয়েই আমরা নেই। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে হেকেপ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ইউজিসি। সেখানেও কিন্তু একটা প্যারামিটার ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট স্ব-মূল্যায়ন করে রিপোর্ট দিয়েছে। সেখানেও একধরনের মূল্যায়ন হয়েছে। সেখানে ৯টি ক্ষেত্র আছে। এখন তো একটা প্যারামিটার আমরা সেট করেছি। এতদিন তো আমাদের মান কোথায় আছে সেটা জানার নির্দিষ্ট কোনও উপায় ছিল না। এখন তো নির্ধারণের একটা জায়গা পাওয়া গেছে। আগে আমরা মুখে মুখেই মানের কথা বলতাম। যেমন– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ১৯৯৬ সালে একটি লেখা লিখেছিলেন যে– “প্রাচ্যের অক্সফোর্ড পুরোটাই একটি ‘ভৌতিক’ কথা। এটা মানুষের মুখে মুখে এসেছে।” আমাদের মানের জায়গাটাও একইরকম। আমরা মুখে মুখে বলছি, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদেরকে ভাবছে যে, “আমরাই মডেল”। আমরা নিজেরাই এসব কথা তৈরি করলাম, আবার নিজেরাই কোনও স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করিনি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেটিংয়ের ব্যবস্থাও কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাদের এখানে কেউ করেনি।’       

মুন্নী সাহারাজধানীর পান্থপথে বাংলা ট্রিবিউন স্টুডিও থেকে এ বৈঠকি সরাসরি সম্প্রচার করেছে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজ। পাশাপাশি বাংলা ট্রিবিউনের ফেসবুক ও হোমপেজে লাইভ দেখা গেছে এ আয়োজন। ইউল্যাবের সহযোগিতায় বৈঠকিটি অনুষ্ঠিত হয়েছে।