মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার: সন্ধ্যা নামলেই অন্ধকার, বাড়ছে দুর্ঘটনা ঝুঁকিও

মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে রাতের ছবি সন্ধ্যা নামলেই ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আসে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার। এছাড়া, ফ্লাইওভারের ওপর জমে থাকা আবর্জনা পরিষ্কার না করায় বৃষ্টি হলেই সেখানে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। অন্ধকার ও আবর্জনা থাকার কাররেণ এই ফ্লাইওভারে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া, হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডও ঘটে এই ফ্লাইওভারে। এসব দুর্ঘটনা রোধে ফ্লাইওভারটিতে ল্যাম্পপোস্টের বাতি ও সিগন্যাল বাতি স্থাপনসহ নিরাপত্তা নিশ্চিতে সাড়ে ৪২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয় ৮ দশমিক ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রাজধানীর মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) নির্মিত এ ফ্লাইওভারটি পুরোপুরি যানচলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করতেই লেগে যায় প্রায় দেড় বছর। সবশেষ চলতি বছরের মার্চের দিকে সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর আগে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি দিয়ে এর খুঁটিনাটি সমস্যা চিহ্নিত করে ডিএসসিসি। কিন্তু সেগুলোর কোনও সমাধান এখন পর্যন্ত করা হয়নি।

মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে রাতের ছবি সরেজমিন দেখা গেছে, ফ্লাইওভারটির কোনও অংশে কোনও বাতি জ্বলে না। সন্ধ্যা নামলেই ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আছে। ফ্লাইওভারের ওপরে আবর্জনায় ভরে রয়েছে। বাতি না জ্বালানোয় প্রায় দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন এই পথের নিয়মিত যানবাহন চালকরা। পাশাপাশি ঘটছে অপরাধও।

গত ২৬ আগস্ট দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে রাজধানীর এই ফ্ল্যাইওভারে মিলন (৩৫) এক পাঠাও চালককে গলা কেটে হত্যা করে তার সঙ্গে থাকা বাইকটি নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। আরও বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনার পাশাপাশি ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত তার চুরির কারণেই ফ্লাইওভারটিতে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। এছাড়া, ফ্লাইওভারটি নির্মাণের সময় এর রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে কোনও চিন্তাভাবনা করা হয়নি। রাখা হয়নি বরাদ্দও। ফলে সিটি করপোরেশনও দীর্ঘদিন ধরে এর দায়িত্ব নিতে গড়িমশি করেছে। আর এ কারণেই এর নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিষয় নিশ্চিতের জন্য প্রকল্প চূড়ান্ত করতে সময়ক্ষেপণ হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নির্মাণ শেষে ফ্লাইওভারটির পরিকল্পনায় ত্রুটি, লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতাসহ নানা কারণ দেখিয়ে ফ্লাইওভারটির দায়িত্ব নিতে দীর্ঘদিন ধরে অনীহা দেখিয়ে আসছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। তবে, সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ফ্লাইওভারটির সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর আগে ফ্লাইওভারের ত্রুটির খোঁজে নামে দুই সিটি করপোরেশন।

মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে রাতের ছবি ডিএসসিসি সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে ফ্লাইওভারটি বুঝে নেওয়ার জন্য চিঠি পাওয়ার পর এই ত্রুটি খুঁজতে গত বছরের জুলাই মাসে ডিএসসিসি আন্তঃবিভাগীয় সাতটি কমিটি গঠন করেছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, প্রকৌশল বিভাগ, সম্পত্তি বিভাগ, রাজস্ব বিভাগ ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে। কমিটিগুলো পুরো ফ্লাইওভার পরিদর্শন করে এর ত্রুটি শনাক্ত করে।

দুই সিটির শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, নকশা অনুমোদনের পর থেকেই মগবাজার মৌচাক-ফ্লাইওভার নিয়ে নানা ত্রুটি দেখা দেয়। এরমধ্যে ফ্লাইওভারে ট্রাফিক সিগন্যাল, বৈদ্যুতিক বাতি নষ্ট, বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা, বাম দিকে স্টিয়ারিং, যানজট লেগে থাকা, ওঠা-নামার র‌্যাম্প জটিলতাসহ নামার লুপে যানজট লেগেই থাকে। এসব কারণে ফ্লাইওভারটির ল্যাম্পপোস্টের বাতি ও সিগন্যাল বাতিসহ নিরাপত্তা নিশ্চিতে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে ৪২ কোটি ৫৪লাখ টাকার একটি প্রকল্প স্থানীয় সরকার বিভাগের পাঠানো হয়। বর্তমানে সেটি পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। প্রকল্পটি আগামী এক মাসের মধ্যে অনুমোদন হতে পারে বলে জানিয়েছে ডিএসসিসি। তবে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে পুরো ফ্ল্যাইওভারের বাতি জ্বালানো হলেও সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন নিজ নিজ ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট অংশের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করবে।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান বলেন, ‘মগবাজার মৌচাক ফ্লাইওভারের জন্য এলইডি ও সিগন্যাল বাতি স্থাপন ছাড়াও যন্ত্রপাতি সংগ্রহসহ ফ্লাইওভারের নিচে সড়কদ্বীপের সৌন্দর্যবর্ধনে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। আশা করি, এক মাসের মধ্যে প্রকল্পটি অনুমোদন পাবে। তবে প্রকল্পের মাধ্যমে আমাদের অংশের সব ব্যবস্থাপনা করা হলেও উত্তর সিটির অংশের শুধু বাতির দেখাশোনা করা হবে।’

মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে রাতের ছবি

জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল হাই বলেন, ‘ফ্লাইওভারটি দেখাশোনার দায়িত্ব ডিএসসিসিকে দেওয়া হয়েছে। এরপরও বিষয়টি আমাকে আরও একটু ভালো করে জানতে হবে। যদি আমাদের অংশের বাতি ছাড়া অন্যকিছু ওই প্রকল্পের মধ্যে ধরা না হয়, তাহলে আমাদের অংশের রক্ষণাবেক্ষণ আমরাই করবো।’

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তিন স্তরবিশিষ্ট চার লেনের এই ফ্লাইওভারটির দৈর্ঘ্য ৮ দশমিক ৭ কিলোমিটার। এটি ১০ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল। ১ হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ হাজার ৬৯ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এর প্রতি মিটারে খরচ হয়েছে ১৩ লাখ টাকা।

ফ্লাইওভারটির নির্মাণ কাজ করা হয়েছে তিন ভাগে। প্রথম অংশ সাতরাস্তা-মগবাজার-হলি ফ্যামিলি পর্যন্ত। এই অংশটি ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ফ্লাইওভারটি উদ্বোধন করেন।

এই ফ্লাইওভারটির দ্বিতীয় অংশ হলো, বাংলামোটর-মগবাজার-মৌচাক-রাজারবাগ পর্যন্ত। এই অংশটি যান চলাচলের জন্য গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর উন্মুক্ত করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

ফ্লাইওভারটির তৃতীয় অংশ রামপুরা চৌধুরীপাড়া-মৌচাক-মালিবাগ-শান্তিনগর অংশ ২৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।