সম্রাটের পতন (ভিডিও)





 গত ১৮ সেপ্টেম্বর র‌্যাবের ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর আগেও ইসমাইল হোসেন সম্রাটের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ তোলার বিষয়টি ছিল অনেকের কাছেই কল্পনাতীত। কারণ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি সম্রাট মানেই ‘আতঙ্ক’। এই আতঙ্কের বিষয়টি অবশ্য একদিনে তৈরি হয়নি। ১৮ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে নেতিবাচক অর্থে সম্রাট তার নামের পরিচয় দিয়েছেন নানা অপকর্মে। কাকরাইলের যে ভবনে তিনি দীর্ঘদিন ধরে তার বাহিনী নিয়ে সদর্পে ছিলেন, সেখানেই রবিবার (৬ অক্টোবর) তাকে হাতকড়া ও মাথায় হেলমেট পরিয়ে নেওয়া হয়। এ সময় তাকেই দেখা যায় উল্টো আতঙ্কগ্রস্ত। আটকের পর ১২ ঘণ্টা র‌্যাব হেফাজতে থাকা যুবলীগের বহিষ্কৃত এই নেতাকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে ছয় মাসের দণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাকে কারাগারে পাঠানোর সময় অনেককেই বলতে শোনা যায়, ‘বেশি বাড়লে অবস্থা এমনই হয়।’

ঢাকার সম্রাট কুমিল্লায় গ্রেফতার

রবিবার ভোরের দিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে’ সম্রাটকে তার সহযোগী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমানসহ গ্রেফতার করে র‌্যাব। এরপর তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। র‌্যাব সদর দফতরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কাকরাইলে সম্রাটের অফিসে অভিযান চালানো হয়। র‌্যাবের হাতে আটকের পরপরই যুবলীগ থেকে সম্রাটকে বহিষ্কার করা হয়।

সম্রাটের রাজনৈতিক জীবন

রাজনীতিতে সম্রাটের আগমন ঘটে ১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে। এ সময় কিছু দিন ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। অবশ্য তার আগে এরশাদের জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্রসমাজের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ছিল বলে তার পরিচিতজনেরা জানিয়েছেন। বিএনপির ১৯৯১-৯৬ আমলে ছাত্রলীগ ছেড়ে যুবলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ২০০৩ সালে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। সে সময় দক্ষিণের সভাপতি ছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ মহি আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন। মূলত শাওনই সম্রাটকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। পরবর্তীতে ২০১২ সালে সম্রাট ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি হন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে।

সম্রাটের শান্তিনগরের বাসায় অভিযানসম্রাটের ব্যক্তিজীবন
ফেনীর পরশুরাম উপজেলার অধিবাসী সম্রাটের বাবা রাজউকে চাকরি করতেন। বাড়ি পরশুরামে হলেও সেখানে তাদের পরিবারের কেউ থাকে না। বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকায় বড় হন সম্রাট। পরিবারের সঙ্গে প্রথমে বসবাস করতেন কাকরাইলে সার্কিট হাউস সড়কের সরকারি কোয়ার্টারে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, সম্রাটের দুই স্ত্রী। প্রথম পক্ষের স্ত্রী বাড্ডায় থাকেন। প্রথম পক্ষে সম্রাটের এক মেয়ে। তিনি পড়াশোনা শেষ করেছেন। সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরী মহাখালীর ডিওএইচএসে থাকেন। তার এক ছেলে। তিনি মালয়েশিয়ায় এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। শারমিন চৌধুরী বলেন, ‘সিঙ্গাপুরে সম্রাটের বিদেশি একজন বান্ধবী আছেন। সেখানে তিনি মাঝে মাঝে সময় কাটাতে যান।’
১৯ বছর আগে (২০০১) সম্রাট ও শারমিন চৌধুরীর বিয়ে হয়। তবে দুই বছর ধরে এই বাসায় সম্রাটের আসা-যাওয়া ছিল না বলে দাবি করেন শারমিন।

কাকরাইলের অফিসে অভিযান শেষে সম্রাটকে নিয়ে যাচ্ছে র‌্যাবকারাগারে সম্রাট-আরমান
রবিবার সন্ধ্যায় সম্রাট ও আরমানকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে সম্রাটকে এবং ‘মদ্যপ’ অবস্থায় পাওয়ায় আরমানকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে গ্রেফতারের সময় আরমানকে মদ্যপ অবস্থায় পাওয়া যায়। এজন্য তাৎক্ষণিকভাবে তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠান ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরে সম্রাটকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।
রাজনীতিবিদদের প্রতিক্রিয়া
রবিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন (আইইবি) মিলনায়তনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আপনারা যাদের সন্দেহ করেছেন, গ্রেফতার হয়েছে। সামনে আরও গ্রেফতার হবে। এটা কোনও ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়। যে অপরাধী, তাকে গ্রেফতার করা হবে, আইনের আওতায় আনা হবে। সরকার এ ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ। এই লক্ষ্য সামনে রেখেই শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে।’
ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আব্দুর রব বলেন, ‘সম্রাটের কাছ থেকে আরও বহু সাম্রাজ্যের খবর পাওয়া যাবে। টপ-টু-বটমের অনেক খবর পাওয়া যাবে।’
সম্রাটের মহাখালীর বাসাসাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া
সম্রাটকে যখন তার কাকরাইলের অফিস থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন অনেককেই নানা ধরনের বিক্ষিপ্ত মন্তব্য করতে শোনা যায়। যেমন ‘এত কিছু লাগে কেন?’, ‘কত টাকা লাগে?’ ‘এত বাড়া ঠিক হয়নি’, ‘বেশি বাড়লে তার পতন অনিবার্য’ ইত্যাদি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নিরাপত্তাকর্মী বলেন, ‘এই অফিসে এমন কোনও খারাপ কাজ নাই যা হতো না। সব হতো এখানে। বেশি বাড়লে এভাবেই পতন হয়।’
তিনি বলেন, ‘সম্রাট একা নয়, তার সঙ্গে অনেকেই জড়িত। তাদের সবাইকে না ধরলে প্রতিদিনই সম্রাট তৈরি হবে।’
সম্রাটের মহাখালীর বাসায় র‌্যাবের অভিযানর‌্যাবের বক্তব্য
র‌্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর দুই-একদিন পরই সম্রাট ঢাকা ছেড়ে আত্মগোপনে ছিলেন। আত্মগোপনে থাকতে তিনি বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যেসব জায়গায় ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছি, সেসব জায়গা থেকে সম্রাটের নাম বারবার এসেছে। ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগেই তাকে আটক করা হয়েছে।’ সম্রাটের সঙ্গে আরমান নামে একজনকে আটক করা হয়েছে, সেও এই ক্যাসিনোর সঙ্গে যুক্ত বলে জানান তিনি।

ভিডিও—