মশক নিধনে ‘অকার্যকর’ ওষুধ এখনও ব্যবহার করছে ডিএনসিসি (ভিডিও)

নোকন কোম্পানির অকার্যকর এ ওষুধ এখনও ব্যবহার করছে ডিএনসিসিডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নতুন ওষুধ ব্যবহার করতে প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি উচ্চ আদালতের নির্দেশ রয়েছে। সে অনুযায়ী বিশেষ বিমানযোগে চীন ও ভারত থেকে নতুন ওষুধ আমদানি করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি)। এজন্য পৃথক দুটি টেকনিক্যাল কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই আবারও পুরনো ‘অকার্যকর’ ওষুধ ব্যবহার করছে ডিএনসিসি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ও মাঠপর্যায়ে সরেজমিনে গিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তবে ডিএনসিসি বলছে, তারা পুরনো ওষুধের পাশাপাশি নতুন ওষুধও ব্যবহার করছে।

এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এজন্য দুই সিটি করপোরেশনের ব্যবহৃত ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। একপর্যায়ে দুই সিটি করপোরেশন স্বীকার করে, তাদের ওষুধে মশা মরে না। এতে করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন দুই মেয়র।

এ অবস্থায় গত ২৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) মো. আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় পরের তিন দিনের মধ্যে দুই সিটি করপোরেশনকে নতুন ওষুধ সংগ্রহ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ১ আগস্ট সরাসরি ওষুধ আমদানির লাইসেন্স পায় ডিএনসিসি।

এরপরেও জটিলতা না কাটায় বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। একপর্যায়ে এডিস মশা নির্মূলে দ্রুত দেশের বাইরে থেকে কার্যকর নতুন ওষুধ আনার নির্দেশ দেন আদালত। গত ১ আগস্ট বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এর আগে ২৫ জুলাই আদালতের একই বেঞ্চ নতুন ওষুধ না আসা পর্যন্ত বিদ্যমান ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে দুই সিটি করপোরেশনকে যৌথভাবে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন।

গত ৭ আগস্ট এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, ‘বেশ কয়েকটি উপাদানের সংমিশ্রণে আমরা একটি ওষুধ ব্যবহার করি। তার মধ্যে একটি উপাদান নিয়ে এক ব্যক্তি গবেষণা করেছে। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, ওষুধের একটি উপাদান অকার্যকর। বাকি দুটি উপাদানের কার্যকারিতা আছে। তবে ওই ওষুধটি আমাদের নিজস্ব ফিল্ড পরীক্ষা, প্ল্যান প্রোটেকশন উইংয়ের পরীক্ষা ও আইইডিসিআরের পরীক্ষায় কার্যকরিতা পাওয়া গেছে। পরে তারা মিডিয়াতে এটা ছড়িয়ে দেন। তখন আমাদের মেয়র মহোদয় বলেছেন, যেহেতু অভিযোগ আছে, তাই এর চেয়েও যদি বেশি কার্যকর ওষুধ পাওয়া যায়, আমরা সেটি ব্যবহার করবো।’

ড্রাম ভর্তি পুরনো ওষুধ

এর পর চীনের নানজিং ইকো ফার্ম বায়োটেকনোলজি লিমিটেড থেকে ম্যালাথিউন ওষুধ আমদানি করে ডিএনসিসি। এজন্য বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশারের নেতৃত্বে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে ডিএনসিসি।

অভিযোগ উঠেছে সেই অকার্যকর পুরনো ওষুধ ব্যবহার বন্ধ করেনি ডিএনসিসি। বাংলা ট্রিবিউনের কাছে বিষয়টি স্বীকার করেছেন ডিএনসিসির মশক সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির প্রধান ও ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা পুরনো ওষুধ ব্যবহার করছি এটা সত্য। পাশাপাশি নতুন ওষুধও ব্যবহার শুরু করেছি। এখনও এক লাখ ১০ হাজার লিটার সরাসরি ব্যবহার উপযোগী (রেডি ফর ইউজ) নতুন ওষুধ আছে। এই ওষুধ প্রস্তুত করতে যে পরিমাণ কাঁচামাল বা ম্যালাথিউন প্রয়োজন, সেটি চীন থেকে এলসির মাধ্যমে আনা হয়েছে। তবে কী পরিমাণ ওষুধ (ম্যালাথিউন) আনা হয়েছে সেটি প্রধান ভান্ডার কর্মকর্তা বলতে পারবেন। আর পুরনো যে কোম্পানিকে চার লাখ লিটার ওষুধ দেওয়ার জন্য আগে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে, সেই কার্যাদেশের ওষুধ সরবরাহ এখনও শেষ হয়নি। কার্যাদেশ বাতিলও হয়নি। তারা কয়েক ধাপে আমাদের ওষুধ দিয়েছে। তাই এখনও তাদের সেই ওষুধ ব্যবহার হচ্ছে।’

আদালতের নির্দেশ ছিল আগের ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এর মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া, সেটা পালিত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে আবদুল মান্নান বলেন, ‘ডোজ বাড়িয়ে দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। আগের মতোই ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে আমরা লার্ভিসাইডিংয়ের (লার্ভা নিধন) দিকে বেশি নজর দিচ্ছি। কারণ, অ্যাডাল্টিসাইডিংয়ে (উড়ন্ত মশা) মশা মরে না।’

ডিএনসিসির টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘ডিএনসিসির প্রধান ভান্ডার কর্মকর্তার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, তারা আগের ওই কোম্পানিকে (নোকন) যে কার্যাদেশ দিয়েছেন, সেই কার্যাদেশে গ্রহণ করা ওষুধ এখনও ব্যবহার করছেন। এটা কেন যে করছেন, সেটি আমার জানা নেই। কথা ছিল নতুন ওষুধ ব্যবহার করবেন।  যেহেতু আদালতের নির্দেশ রয়েছে, তাই এটাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’

মাঠ পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য পুরনো ওষুধের ড্রাম ট্রাকে তোলা হচ্ছেএকই কমিটির প্রধান মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘কোন ওষুধ ব্যবহার করছে, সেটি আমি জানি না। কমিটি গঠন করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা (ডিএনসিসি) কী করছে না করছে, আমাদের কিছুই জানাচ্ছে না। আমরা শুধু বিবেকের তাড়নায় বিভিন্ন দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়ে থাকি। যেহেতু আমাদের টেকনিক্যাল কমিটিতে রাখা হয়েছে, সেহেতু তাদের (ডিএনসিসি) উচিত হবে কখন কোন ওষুধ ব্যবহার করছে, সে বিষয়ে আমাদের অবহিত করা।’ 

গত বুধবার (২৩ অক্টোবর) নগর ভবনে ‘মশক নিয়ন্ত্রণে বর্তমান কার্যক্রম ও বছরব্যাপী পরিকল্পনা’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে মেয়র আতিকুল ইসলামের কাছে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্ন ছিল—ডিএনসিসিতে এখনও মশার পুরনো ওষুধ ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে, এই অভিযোগ সঠিক কিনা? জবাবে মেয়র বলেন, ‘চীন থেকে আমদানি করা এক লাখ লিটার নতুন ওষুধ আমাদের মজুত রয়েছে।’ তবে পুরনো ওষুধ ব্যবহার হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে তিনি কিছুই বলেননি।

গত ২২ অক্টোবর সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে ডিএনসিসির সাবেক প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, সংস্থাটির পরিচ্ছন্নতা বিভাগের একটি ট্রাকে (ঢাকা মেট্রো-উ ১১-৪০৭৮) করে নোকন লিমিটেডের তিন ড্রাম পুরনো ওষুধ (রেডি ফর ইউজ) ঢাকেশ্বরীতে অবস্থিত ঢাকা মশক নিবারণী দফতরে নেওয়া হচ্ছে। পরে সেখানকার স্টোরকিপার গিয়াস উদ্দিনের কাছে এই তিন ড্রাম ওষুধের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনও তথ্য দিতে রাজি হননি। ওপরের নির্দেশ ছাড়া কোনও কথা বলতে পারবেন না বলে জানান গিয়াস উদ্দিন।

ডিএনসিসির ভান্ডারে (সাবেক প্রধান কার্যালয়) গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে নোকন লিমিটেডের কয়েকশ’ ইনটেক ড্রাম ওষুধ রয়েছে। অন্যদিকে ডিএনসিসির অঞ্চল-১ (কারওয়ান বাজার) এর প্রধান কার্যালয়ে গিয়েও ড্রামভর্তি  মশার পুরনো ওষুধ দেখা গেছে।’

এ বিষয়ে জানতে নোকন লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার মো. খালিদ হোসেনকে ফোন করা হলে তিনি প্রথমে কথা বলতে সম্মত হন। পরে মশার ওষুধ সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাইলে রাতে ফোন করার কারণে তিনি রেগে গিয়ে ফোন রেখে দেন। যদিও তখন সময় ছিল রাত ৮টা ৩১ মিনিট। 

বিষয়টি সম্পর্কে একাধিকবার ফোন করা হলেও ডিএনসিসির প্রধান ভান্ডার কর্মকর্তা জাকির হোসেন ফোন ধরেননি। এসএমএস পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।

এরপর গত ২১ অক্টোবর প্রধান ভান্ডার কর্মকর্তার দফতে গেলে তার ব্যক্তিগত সহকারী আল আমিন এ প্রতিবেদককে অপেক্ষা করতে বলেন। দীর্ঘ এক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরেও তিনি সাক্ষাৎ না দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে যান।