‘সব কবিতা গান হয় না’

271A6027সব কবিতা গান হয় না। গান হওয়ার উপযোগী কবিতাকে আমি গীতিকবিতা বলি। জুলফিকার রাসেলের গীতিকবিতা সমগ্র ‘জলের দামে’ প্রসঙ্গে এসব কথা বলেন গীতিকবি ও শতাধিক বাংলা চলচ্চিত্রের কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপের রচয়িতা মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। তিনি বলেন, রাসেলের বইয়ে ‘গীতিকবিতা সমগ্র’ শব্দটি খুব ভালো লেগেছে।
ঢাকা লিট ফেস্টের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) বিকালে বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে গীতিকার, লেখক ও বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদক জুলফিকার রাসেলের গীতিকবিতার প্রথম খণ্ড ‘জলের দামে’-এর মোড়ক উন্মোচন হয়। এরপর ‘গীতিকবিতায় জুলফিকার রাসেল’ শীর্ষক আলোচনা হয়।
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানএই আলোচনায় মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান বলেন, “আমাকে যখন কেউ বলেন ‘আপনি গান লেখেন, তখন আমি বলি—না, আমি গান লিখি না।’ আমি যদি গান লিখি তাহলে কিছুই শোনা যাবে না। কারণ, গান মানুষ শোনেন। গান পড়তেও আসেন না। ফলে আমি গান যদি লিখি, সেটা তো শোনা যাবে।”
তিনি বলেন, ‘আমি এমন একটি কবিতা লিখি যেটা কোনও একটি সুরের জন্য প্রতীক্ষা করে আছে। পড়লেই মনে হবে সুরের প্রতীক্ষায় আছে এবং এরপর সুর পাওয়ার পরে কারও কণ্ঠ মিলে গেলে তখন মানুষ গান শুনতে পান। আর আমি যেটা লিখি, সেটা কবিতা। সব কবিতা গান হয় না। গান হওয়ার উপযোগী কবিতাকে আমি গীতিকবিতা বলি।’ রাসেল অসম্ভব নিষ্ঠাবান বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মনি জামানআজ গানের খুব বাজে অবস্থা উল্লেখ করে মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান আরও বলেন, ‘গান লিখবেন কবি। শব্দে শব্দে মিল করে কোনোরকমভাবে গান যারা তৈরি করেন, তাদের হাতেই আজ গানের কথার খুব বাজে অবস্থা। এ থেকে আমাদের রক্ষা পেতে হবে এবং রাসেলরাই পথ দেখাক।’
‘গীতিকবিতা’ শব্দটির ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “গীতিকবিতা অর্থাৎ এমন কবিতা, যেটা গান হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং ‘গীতিকার’ শব্দটি আমি একেবারে পছন্দ করি না। কারণ, তিনি কবি। কবি ছাড়া কারও গান লেখার অধিকার নেই; কবি হতে হবে। জুলফিকার রাসেলের লেখায় আমি অনেক আগেই কবিতা পেয়েছি।”
নকীব খানসুরকার মনি জামান বলেন, ‘আমার সঙ্গে রাসেলের প্রথম পরিচয় বইমেলার সময় এই বাংলা একাডেমির পুকুর পাড়েই। তার একটি দর্শন ছিল, সেটাই প্রকাশ করতে চেয়েছিল বলেই তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। রাসেলের ভেতরে সৃষ্টিশীল সত্তাটি সবসময় কাজ করেছে। রাসেলের লেখার ভেতরে অনেক দিক-বিদিক আছে। তার লেখা একদিক থেকে আরেকদিক চলে গেলেও শেষমেশ কিন্তু বাড়িতেই চলে আসে। তার লেখার গাঁথুনি আমার কাছে ভিন্ন মনে হয়। তার একেকটা লেখার চলন একেক রকম। তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে সুরগুলো ভিন্ন ধাঁচের হয়। আমরা আসলেই ভাগ্যবান! একজন তরুণ গীতিকবির জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে যেন আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হয়, যেন এই বাংলাদেশকে অনেক কিছু দিতে পারে।’
ফাহমিদা নবী

সুরকার, গীতিকার ও শিল্পী নকিব খান বলেন, “রাসেলকে আমরা পরিবারের একজন মনে করি। তার লেখা গান প্রথম আমরা ‘রেনেসাঁ’ অ্যালবামে করেছি। তারপর আমার একক অ্যালবামে করেছি। একজন গীতিকবি যখন গান লেখেন, আমি মনে করি গানটি আসলেই একটি সৃষ্টি, একটি ছোটগল্পের মতো। একটি থিম থাকবে, সেটা কিন্তু সুরের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, সেখানে যারা সুরস্রষ্টা আছেন, তাদের কাজই কিন্তু গীতিকবিতাকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা।”

তিনি আরও বলেন, ‘এই বয়সে জুলফিকার রাসেল যে গভীরতার কথা লিখেছে গানে, আমি সত্যি অভিভূত। আমার মধ্যে একটি খুঁতখুঁতে ভাব আছে, আমি প্রথমেই কিন্তু গানের কথা নিয়ে খুব চিন্তা করি। প্রথমে আমি গানের কথা দেখি, আমি শতভাগ সন্তুষ্ট না হলে কিন্তু সুর করি না। সেখানে জুলফিকার রাসেল এমন একজন গীতিকবি, যার কোনও গান নিয়ে আমার দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে হয়নি।’

বাপ্পা মজুমদারবিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ফাহমিদা নবী বলেন, ‘যোগ্য মানুষ যখন স্বীকৃতি পায় তখন আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। একটা ভালো গান না পেলে একজন শিল্পী ভালোভাবে গাইতেও পারেন না, গানটি মানুষের কাছে পৌঁছায়ও না। গানের কথা ও সুর যখন সমন্বয় তৈরি করে, তখন কিন্তু সেটা প্রাণ পায়।’
তিনি আরও বলেন, “রাসেল এত অল্প বয়স থেকেই এত দামি কথা লেখে, সেই জুলফিকার রাসেল আজকে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। এবং, রাসেল যখনই আমাদের গান করতে বলে, আমরা ‘না’ করি না। কারণ, তার লেখার মধ্যে এমন কিছু আছে, যেটা শুধু আমরা শিল্পীরাই নয়, শ্রোতারাও একে গ্রহণ করতে চান। রাসেলের গানের কথার মধ্যে অপূর্ব কিছু বিষয় আছে, যা মানুষকে টানে। যা মানুষকে টানে তা সমাজ তৈরি করে, তা আমরা বিশ্বাস করি। আর আমাদের এখন যে বর্তমান সময়, ভালো গীতিকবির খুব প্রয়োজন। কারণ, অকারণ গান করে কোনও লাভ নেই।”

সামিনা চৌধুরীএ সময় সুরকার, গীতিকার ও শিল্পী বাপ্পা মজুমদার বলেন, ‘এত চমৎকার একটি আয়োজনে রাসেল আমাকে সম্পৃক্ত করায় আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই। আসলে আমরা যেটাকে গান বলি, সেটার মূল জায়গা হলো কবিতা। সেই কবিতা নিয়ে রাসেল যেভাবে কাজ করে আসছে, তার লেখা নিয়ে কথা বলতে গেলে শেষ করা যাবে না। বাসুদা (সংগীত পরিচালক বাসুদেব ঘোষ) আমাদের সামনে রাসেলের লেখা একটি গান নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন, রাসেল তা নিজেও জানতো না। বাসুদা দিয়ে বলেছিলেন, বাপ্পা, দেখো তো গান গাওয়া যায় কিনা! সেই থেকে রাসেলের গান নিয়ে কাজ করা শুরু। আমার দ্বিতীয় অ্যালবামের জন্য একটি কাজ করলাম। এরপর তো আমরা কাজ করেই যাচ্ছি। সর্বশেষ কাজ করেছি ‘একমুঠো গান-২’-এ। আমি ভীষণ আনন্দিত যে সফলতা আগেও এসেছিল এবং এখনও আসছে। আমি আসলেই আপ্লুত রাসেলের এই বিশাল অর্জনে।’




জুলফিকার রাসেলসংগীতশিল্পী সামিনা চৌধুরী বলেন, ‘একজন শিল্পীর রাগ, জেদ, অভিমান, ভালোবাসা, মায়া থাকতে হবে। রাসেলের ওইটুকু আছে, জেদের কারণেই প্রতিটি গান সৃষ্টি করেছে। মানুষের জীবনের অনেক ধরনের অনুভূতি থাকে, এসব অনুভূতি নিয়ে রাসেল গান গেয়েছে। যখন যেটা লিখেছে, সেটা আমার কাছে নিজেরই কথা মনে হয়েছে।’
আলোচনা শেষে জুলফিকার রাসেল সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে রবি চৌধুরী, ফাহমিদা নবী ও বাপ্পা মজুমদার গানে গানে শুভেচ্ছা জানান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী সাংবাদিক মুন্নী সাহা।