বাঙালি রসনার সঙ্গে পানের সম্পর্ক বহু বছরের পুরনো। এই জাতির নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিজস্ব অভ্যাসে এ মুখবিনোদন চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঠোঁটরাঙা এ রসনা বিলাসিতায় খানিক ঝাঁজ এনেছে দাম। গত দুই মাসে প্রতিবিরা (৮০ পিস) উন্নত পানে বাড়তি যুক্ত হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। অঞ্চল ভেদে ঝাল-মিষ্টি স্বাদের বিভিন্ন জাতের পানের দামের সঙ্গে বেড়েছে সুপারির দামও। আসছে নতুন বছরের প্রথম দিকে পানের দাম আরও দেড়গুণ বাড়তে পারে, এমন শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
পানমুখী একনারীর ভাষ্য— কেবল পানসুপারি নয়, জর্দার দামও বেড়েছে অন্তত তিন টাকা। ১৮ বছর পান খেয়ে চলা এই নারীর আক্ষেপের স্বরে আরও একটু উদ্বেগ বাড়িয়ে দিলেন পানবিক্রেতা নূর আলম— ‘বাড়ে নাই, বাড়ে নাই। পানের দাম আরও বাড়বে। সামনের বছর মিষ্টি খিলি পানের বিরা অন্তত ৩২০ টেকা হবে।’
রাজধানীর মহাখালীতে নূর আলমের দোকানে দাঁড়িয়ে বুধবার (১১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদকের কথা হচ্ছিল পানের বাজারের ভালোমন্দ নিয়ে, কেমন চলছে পানব্যবসা। মহাখালী কাঁচাবাজার সংলগ্ন মসজিদের পাশেই তার দোকান।
বাজারে রাজশাহীর পান ‘মিষ্টি’ আর বরিশালের পান ‘ঝাল’ জানিয়ে নূর আলম বলেন, ‘বরিশালের পান প্রতিবিরা ১৪০ টাকায় বিক্রি করছি। আমার দোকানে পান আসে রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ আর বরিশাল থেকে।’
‘বরিশালের ছোট পান আর দেশি পান বিক্রি করছি এতদিন ৫০-৬০ টাকায় (প্রতিবিরা)। এখন কিনতে হয় ১১০-১২০ টাকায়। কিন্তু ধরেন কাস্টমারের কাছে পানের দাম বাড়াইতে পারি নাই। সেই পাঁচ টাকাতেই (খিলি) বিক্রি করতে হয়’, বলছিলেন রাজধানীর পশ্চিম পান্থপথ এলাকায় চা-পান স্টলের বিক্রেতা আরিফ হোসেন।
কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সারাদেশে ৫৪ হাজার ৮৯০ একর জমিতে পান চাষ হয়েছে। বিগত ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অবশ্য ৫ হাজার একর বেশি জমিতে পান চাষ হয়। সর্বশেষ তিন অর্থবছরে ঘুরে-ফিরে সোয়া দুই লাখ মেট্রিক টন পান উৎপাদিত হয়েছে সারাদেশে।
খুলনা অঞ্চলের পর চট্টগ্রাম অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পান চাষ হয়। এ অঞ্চলে গত দুই অর্থবছরে পানচাষে জমির পরিমাণ কমলেও উৎপাদনের গড়মাত্রা অপরিবর্তিত ছিল। কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার বড় মহেশখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনায়েত উল্লাহ বাবুল জানান, তার ইউনিয়নের প্রায় অর্ধেক কৃষকই পান চাষের সঙ্গে যুক্ত। তিনি বলেন, ‘পানের দাম কিছুটা বেড়েছে। প্রথমত পানের বরজ বাড়েনি। দ্বিতীয়ত শীতের মৌসুমে দাম কিছুটা বাড়ে। এসময় পান উৎপাদন কম থাকায় দাম বেড়ে যায়।’ তার ভাষ্য, ‘পানচাষিদের জীবন-যাপন সাধারণ কৃষকের মতোই, খেয়ে-পরে চলে যায়।’
‘নভেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে যে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে, এরই প্রভাবে বাজারে পানের দামে প্রভাব ফেলেছে। এই ঝড়ে বরিশাল এলাকা ছাড়াও সারাদেশেই পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. নূরুল ইসলাম।
লেখক মীজানুর রহমানের গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী, ১৯১৯ সালে প্রবল ঝড়ের পর উন্নত মানের পান চাষ কমে গেলে নারায়ণগঞ্জের সাঁচিবন্দরের পান বাজার বন্ধ হয়। এরপর অনেক পরে এসে ঢাকার শ্যামবাজারে পান বিক্রির হাঁট বসে।
ঢাকার শ্যামবাজারে অবশ্য এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। হাঁট থেকে গড়ে উঠেছে আড়ত, আর আড়তেই হয় পানের মূল বিকিকিনি। কোনও-কোনও আড়তদার শ্রমিকদের আবাসিক জায়গাও করে দিয়েছেন আড়তের ভেতরে। বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগে থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন পান ব্যবসায়ীরা। সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পান আসে শ্যামবাজারে। তবে বেশি আসে বরিশাল-খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে।
গত কয়েক বছর ধরে বিদেশে পান রফতানি হচ্ছে কম বলে জানান শ্রাবণ পান সোসাইটির অন্যতম মালিক দ্বীন ইসলাম। দামের ওঠানামা খুবই স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেন তিনি; বলেন, ‘কাঁচা পাতার ব্যবসা। আজকে (২৩ ডিসেম্বর) বরিশালের ভালো পান পাইকারি বিক্রি হচ্ছে প্রতিবিরা ১২০ থেকে ১৪০ টাকায়।’ ১৮ বছর পান ব্যবসায় সহযোগী হিসেবে কাজ করে গত তিন বছর ধরে নিজের আড়ত খুলেছেন দ্বীন ইসলাম ও তার সহযোগী কাওসার। ‘পানের দাম এই মুহূর্তে ভালোই’ হিসেবে দেখলেও বছরে অন্তত কয়েকবার বেশ লোকসানের মুখে পড়তে হয় তাকে। দ্বীন ইসলাম জানান, এ বছরের বর্ষার সময় তাকে বিরাপ্রতি ৪-৫ টাকায় পান বিক্রি করতে হয়েছে।
গত সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রাজশাহীর মিষ্টি পান ৮০ বিরা ১২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে শ্যামবাজারে। কোনও কোনও পাইকারি ব্যবসায়ী প্রতিবিরা পান ১৫০ টাকার নিচে বিক্রি করতে নারাজ। আড়তের বাইরে আরও অন্তত শতাধিক ব্যবসায়ী পানের পাইকারি বিক্রির সঙ্গে যুক্ত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
‘মালে-মালে দাম। কোনোটাই ফিক্সড না। মাল বেশি উঠলে দাম কমে, কম উঠলে দাম অটো বাড়ে’— সাদ্দাম হোসেন বলছিলেন পানের দামের ওঠানামা নিয়ে। তিনি জানান, ১০ বছর আগে বরিশালের খিলি পান শ্যামবাজারে প্রতি ৮০ বিরা বিক্রি হয়েছে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকায়।
রবিবার বরজ থেকে তুলে সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) ঢাকার শ্যামবাজারে পান এনেছেন বরিশাল জেলার হিজলার পানচাষি হানিফ মোল্লা। সাত বছরের চুক্তিতে তিনি সেখানে পান চাষ করছেন। বছরে এককড়া (২ শতাংশ) জমির জন্য একহাজার টাকা করে ভাড়া দিতে হয় জমির মালিককে।
পান চাষে লাভের মুখ দেখছেন বরিশালের পানচাষী হানিফ মোল্লা। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘ফসল ওঠার ওপরে আমাদের লাভলস নির্ভর করে। গত একবছরে একলাখ টাকার মতো লাভ উঠছে।’ এই আয়ে কেমন বিনিয়োগ ছিল হানিফ মোল্লার, এমন প্রশ্নে তার উত্তর, ‘খাটাইসি ধরেন প্রায় ছয় লাখ। একলাখ সব খরচ বাদ দিয়া রইসে।’
বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের পানচাষি ফারুক, বাকু ও মুক্তার জানান, পান চাষ করেই তাদের পরিবার চলছে। তাদের প্রত্যেকের ঘরের অন্তত দুজন সন্তান পড়াশোনা করছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। পানের ব্যবসায় আগামী দিনে আরও মনোযোগী হবেন তারা।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের হিসাব মতে, গত ১০ বছরের মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ০.৭৫ মেট্রিক টন পান রফতানি হয়েছে দেশের বাইরে। চলতি অর্থবছরে রফতানি হলেও তার হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি।
কৃষি তথ্য অফিসার মো. মঞ্জুর হোসেন জানান, গত কয়েক বছর ধরে পান রফতানি বন্ধ ছিল। এবছর আবার পান রফতানি হয়েছে, যার হিসাব তৈরি করা হচ্ছে।
রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলার চেয়ারম্যান অনিল কুমার বাংলা ট্রিবিউনকে সরকার জানান, তার উপজেলায় অন্তত ২৫ হাজার কৃষক পান চাষের সঙ্গে যুক্ত। তার দাবি, আলু সংরক্ষণের মতো পান সংরক্ষণেও স্টোরেজ দরকার। এতে করে কৃষকেরা যেমন উন্নতি করবে, তেমনি পান রফতানি সহজ হবে।
শ্যামবাজারের আড়তদার দ্বীন ইসলাম মনে করেন, পান কাঁচাপাতা হওয়ায় স্টোরেজে রাখার কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই। পানের বাজার দেশেই ভালো।
বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ১৯৭৪-৭৫ সালে ইউরোপে ও নব্বই দশকের শুরুতে সৌদিতে পান রফতানি করে বাংলাদেশ।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের আমলে ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস টেলর তার ‘কোম্পানি আমলে ঢাকা’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন— ‘ঢাকা অঞ্চলে তিন প্রকারের পান উৎপন্ন হতো। এরমধ্যে এলাচি ও কর্পুর নামের সুগন্ধিযুক্ত পান উৎপাদন হতো ঢাকায়।’
কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিসংখ্যান বলছে, সারাদেশের মধ্যে কেবলমাত্র ঢাকা জেলা, সিরাজগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও ও সুনামগঞ্জ জেলায় ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কোনও পান চাষ হয়নি। নীলফামারী জেলায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মাত্র একএকর জমিতে পান চাষ হলেও গত দুই অর্থবছরে পানচাষের কোনও তথ্য মেলেনি। এছাড়া, গত অর্থবছরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও মানিকগঞ্জ জেলায় পান চাষের কোনও পরিসংখ্যান পায়নি কৃষি তথ্য সার্ভিস।
বাঙালির সঙ্গে পানের সম্পর্ক বলতে গিয়ে লেখক-চিন্তক যতীন সরকার বলেন, ‘পানের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাবে না। আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হচ্ছে পান।’
প্রবীণ এই বুদ্ধিজীবী আরও যোগ করেন, ‘আমাদের শিল্পসাহিত্যের শুরু থেকেই পান-সুপারির কথা এসেছে, আমরা তা পড়েছি। পান-সুপারির সংস্কৃতি বিদেশ থেকে আসেনি।’
ছবি ও ভিডিও: সালমান তারেক শাকিল