ঢাকার গাছে প্রতিদিন ৪৩৬ মেট্রিক টন ধুলা জমে। সেই হিসাবে মাসে ১৩ হাজার মেট্রিক টন ধুলা জমার হিসাব পেয়েছেন গবেষকরা। এই জমে থাকা ধুলা দিনের বেলা বাতাসের সঙ্গে মিশে যেমন দূষণ বাড়ায়, তেমনই রাতে গাড়ির অতিরিক্ত গতির সঙ্গে বাতাসে উড়তে থাকে। আর তাই দিনের বেলা থেকে রাতের বেলা বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যায় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে। স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ঢাকার চারটি পার্ক ও উদ্যানে বিভিন্ন প্রজাতির ৭৭টি গাছের পাতা সংগ্রহের পর ফেব্রুয়ারি মাসে এই গবেষণা পরিচালনা করে।
গবেষকরা পরীক্ষা করে দেখেন, এই পাতাগুলোতে ধূলিকণার পরিমাণ গুলিস্তান পার্কের প্রতি বর্গমিলিমিটারে ২৭ দশমিক ৯৩ মাইক্রোগ্রাম, চন্দ্রিমা উদ্যানে প্রতি বর্গমিলিমিটারে ১১ দশমিক ৩৬ মাইক্রোগ্রাম, রমনা পার্কে প্রতি বর্গমিলিমিটারে ৮ দশমিক ৯৯ মাইক্রোগ্রাম এবং বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রতি বর্গমিলিমিটারে ৪ দশমিক ৮৫ মাইক্রোগ্রাম।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, সবচেয়ে ধুলাপ্রবণ হচ্ছে গুলিস্তান পার্ক। এছাড়া প্রতিটি পার্কে ধুলার বৃদ্ধির হার অপরটির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। রমনা পার্ক ছাড়া বাকি তিনটি পার্কে রাস্তা হতে প্রায় ১০০ মিটার ভেতরে গাছের পাতায় ধুলার উপস্থিতি কম পাওয়া যায় এবং রাস্তা সংলগ্ন গাছের পাতায় উপস্থিতি বেশি পাওয়া গেছে। কিন্তু রমনা পার্কের ভেতরের গাছের পাতায় ধুলার উপস্থিতি বেশি ছিল। গবেষণায় আম পাতায় প্রতি বর্গমিলিমিটারে ৩৫ দশমিক ৭৭ মাইক্রোগ্রাম, দেবদারু গাছের পাতায় প্রতি বর্গমিলিমিটারে ১৮ দশমিক ৬৯ মাইক্রোগ্রাম, কাঁঠাল পাতায় প্রতি বর্গমিলিমিটারে ৮ দশমিক ৮৪ মাইক্রোগ্রাম, মেহগনি গাছের পাতায় প্রতি বর্গমিলিমিটারে ৭ দশমিক ৭০ মাইক্রোগ্রাম, বকুল পাতায় প্রতি বর্গমিলিমিটারে ৩ দশমিক ৬ মাইক্রোগ্রাম পরিমাণ ধুলার উপস্থিতি পাওয়া যায়।
গবেষক দলের প্রধান ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক এবং স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের গবেষণা বলে যে, আগে ৫৮ শতাংশ বায়ুদূষণ বলা হচ্ছিল ইটের ভাটার কারণে। পুরনো যানবাহন এখন এক নম্বর সোর্স। যানবাহন বন্ধ থাকলে ৪৫-৫০ শতাংশ বায়ুদূষণ কমে যাবে বলে আমি মনে করি। আমরা সার্ভে করে দেখেছি যে, ঢাকায় এখনও ৪৬টি লোকেশনে প্রধান সড়কগুলো খোঁড়াখুঁড়ি অবস্থায় আছে। এগুলো ন্যূনতম এক মাস আগে খুঁড়ে রাখা হয়েছে। কিছু কিছু রাস্তা আছে, যেগুলো প্রায় তিন মাস আগে খোঁড়া হয়েছে। এগুলো অরক্ষিত অবস্থায় থাকার কারণে গাড়ি যখন চলে তখন প্রচুর ধুলাবালি আসে। এই ধুলাবালিগুলো রাস্তার পাশের গাছেও জমা হয়। রাতের বেলা যখন যানবাহন কম থাকে, তখন কিন্তু বায়ুদূষণ কমে যায় না।’
ক্যাপসের অপর এক গবেষণায় থেকে দেখা যায় যে, ঢাকা শহরে যেসব গাছপালা রয়েছে, তার মধ্যে বিশেষ করে দেবদারু, আম ও জাম গাছের দূষণ সহ্য ক্ষমতা অন্যান্য গাছের থেকে তুলনামূলক অনেক বেশি। অন্যদিকে টগর, বাগানবিলাস ও কদম গাছের দূষণ সহ্য ক্ষমতা অনেকাংশেই কম। গবেষণায় বলা হয়, চারটি উদ্যান কিংবা পার্কের মধ্যে অতিমাত্রায় দূষিত গুলিস্তান পার্কের গাছগুলো। এতে ধুলার পরিমাণ প্রতি বর্গমিলিমিটারে ২৭ দশমিক ৯৩ মাইক্রোগ্রাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাখহরি সরকারের মতে, গাছের পাতার ওপর ধুলার আস্তর তার বৃদ্ধি ঠেকাতে বড় ভূমিকা রাখে এবং গাছ থেকে যে অক্সিজেনের উৎপত্তি হয়ে থাকে, তাও ব্যাহত হয়। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাছ তার নিজের জন্য খাবার তৈরি করে এবং অক্সিজেন ছেড়ে দেয় বাতাসে। এখন পাতার ওপর যদি ধুলার আস্তর পড়ে, তাহলে পত্ররন্ধ্র বন্ধ হয়ে যাবে। সেটা বন্ধ হয়ে গেলে গাছ বাতাসে অক্সিজেন ছাড়তে পারবে না। তাছাড়া, গাছ সূর্যের আলোও গ্রহণ করতে পারবে না। সূর্যের আলো ছাড়া গাছ সালোকসংশ্লেষণ করতে পারে না। এটা অনেক বড় একটি সমস্যা।’
ঢাকায় কী কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে ও দূষণ রোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, সেসব বিষয়ে একটি গাইডলাইন তৈরি করতে গত নভেম্বর মাসে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে পরিবেশ সচিবের নেতৃত্বে ওই কমিটি গঠন করে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছিলেন আদালত। পরিবেশ অধিদফতর সেই গাইডলাইন তৈরি করেছে এবং হাইকোর্টে জমা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন অধিদফতরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক মো. জিয়াউল হক। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বায়ুদূষণ রোধে হাইকোর্টের নির্দেশ ছিল উচ্চ পর্যায়ের কমিটি করার। আমরা সেটা করেছি। ওই কমিটির মাধ্যমে আমরা একটি গাইডলাইন তৈরি করেছি। সেখানে করণীয় কী কী সেগুলো উল্লেখ করা আছে এবং কার কী কাজ সেটাও উল্লেখ করা আছে। বায়ুদূষণ রোধে আমাদের বেশ কিছু পদক্ষেপ আছে। আমরা এ নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি।’
ছবি: নাসিরুল ইসলাম