বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পরদিন ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারির ঘটনার স্মৃতিচারণ করে রাশেদ খান বলেন, ‘ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কে একটি দোতলা বাড়িতে সেদিন ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আমি (মেনন), রওনক, কাজী জাফর আহমেদ, তিনজনই সেদিন তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। বাড়ির নিচে দেখা হয় বঙ্গবন্ধুকন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে। তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে ওপরে উঠলাম। আমাকে দেখেই তিনি (বঙ্গবন্ধু) চিৎকার করে বললেন, ‘আয় তোরা, স্বাধীনতা এনেছি। সমাজতন্ত্র করবো। তোরা আছিস।’ একদম হুবহু এইভাবে বলেছেন। আমরা তাকে বললাম, ‘আপনি যদি সমাজতন্ত্র কায়েম করেন তাহলে নিশ্চয় আছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি ছিলেন রাশেদ খান মেনন। ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি। রাজনৈতিক পরিবারের এই সদস্যের স্বাধীনতা পূর্ব রাজনীতিতেও ছিল বলিষ্ঠ অংশগ্রহণ। তার পিতা পাকিস্তানের স্পিকার হওয়া সত্ত্বেও বাম ঘরানার রাজনীতি করায় একাধিকবার কারাবরণ করতে হয়েছে তাকে। সেই কারাগারেই বাংলার মুক্তির সনদের রূপকার শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে অনেক অন্তরঙ্গ সময় কেটেছে এই বাম নেতার। একান্ত সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেই সময়ের স্মৃতির ডালি উন্মোচন করেছেন তিনি।
রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। যদিও রাজনৈতিক মতবাদ ও দলের দিক থেকে এক মত-পথের ছিলাম না আমরা। কিন্তু ওই সময়ে মুজিব ভাইয়ের রাজনীতি ছিল অন্যরকম। তখনকার রাজনীতি আজকের মতো ছিল না। এখন তো একজন আরেকজনের মুখও দেখে না। কিন্তু, সেই সময় সব রাজনৈতিক নেতাকেই আমরা নেতা বলেই মানতাম। বঙ্গবন্ধুকে আমরা মুজিব ভাই থেকে জাতির পিতা হওয়া পর্যন্ত দেখেছি। এই সময়ে তাঁর সঙ্গে একটা গভীর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল আমার। এটা কেবল বঙ্গবন্ধু বলেই নয়, সেই সময় রাজনৈতিক দলের যে সংস্কৃতি ছিল, তাতে পরস্পরের প্রতি এই ধরনের শ্রদ্ধাবোধ ছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে আরও ভিন্নতা ছিল এই কারণে যে, তিনি রাজনৈতিক কর্মীকে (বিশেষ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী), সেটা যেই দলের হোক, অত্যন্ত স্নেহ-মমতার চোখে দেখতেন।’
বঙ্গবন্ধুর একটি বিশেষ গুণের উল্লেখ করে ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘‘কর্মীদের ব্যাপারে তিনি অসম্ভব স্নেহশীল ছিলেন। এই দুর্বলতা কেবল রাজনৈতিক কর্মীদের ব্যাপারে নয়, বাংলাদেশের যেকোনও মানুষের ক্ষেত্রেও তার একই দুর্বলতা ছিল। এই অন্যতম বৈশিষ্ট্য তাকে রাজনীতিতে মহান করেছে। তিনি কেবল তার দলের নয়, আমাদের দলের নেতাকর্মীদেরও নাম ধরে চিনতেন। তিনি সবসময় আমাদের তুই সম্বোধন করে কথা বলতেন। এই ‘তুই’ ছিল আন্তরিকতার বন্ধন, এই সম্বোধনটার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, কী রকম ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তার সঙ্গে আমাদের।’’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগরতলা যাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে রাশেদ খান মেনন বলেন, ৬২ সালে যখন আমরা সামরিক শাসন ভাঙলাম, সেই সময় আরেকটা খবর এলো যে শেখ মুজিব আগরতলায় চলে গেছেন। এটা যে সত্য তা আমরা জানতাম, কারণ, তাকে যিনি ড্রাইভ করে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসেই তিনি (বঙ্গবন্ধু) গ্রেফতার হয়ে যান। এরপর আমিও গ্রেফতার হয়ে জেলখানায় যাই। ৬২ সালে আমি থাকতাম পুরনো হাজতে। তিনি থাকতেন ২৬ নম্বর সেলে। তখন জেলখানায় তার সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ হয়নি। তবে তিনি যখন জেল গেটে আসতেন-যেতেন তখন আমরা তাকে দেখতাম।
বঙ্গবন্ধুকে প্রথম প্রত্যক্ষ দেখার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, ৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনের সময় মিছিল নিয়ে তৎকালীন জিন্দাপার্ক যাওয়ার সময় (বর্তমান ২৩, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ওপরতলা থেকে বঙ্গবন্ধু মিছিল দেখে হাত নেড়েছিলেন। ওই মিছিল থেকেই বঙ্গবন্ধুকে প্রথম নিজের চোখে দেখি। এরপর প্রথম তার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দেখা হয়, ৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর যখন মিছিলে গুলি হওয়ায় ফয়েজউল্লাহ, বাবুল, মোস্তাফা মারা যান। তার আগের দিন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জেলে থেকে বেরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। আমরা তাকে বিশাল সংবর্ধনা দেই। কিন্তু, গুলির ঘটনার পরে আমরা সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কাছে যাই একটা বিবৃতি দেওয়ার অনুরোধের জন্য। তাকে বলি গুলির ঘটনায় তিনি বিবৃতি দিলে রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল দেবে। কিন্তু, বিবৃতি দিতে তিনি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। এ নিয়ে আমাদের নেতা কাজী জাফর আহমেদ ও ছাত্রলীগের নেতা শেখ ফজলুল হক মনি দুজনেই সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে বিতণ্ডায় লিপ্ত হন। তারা বলেন যে, আমাদের লোক মারা যাবে আর আপনারা গভর্নর ফারুকের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করবেন এটার কোনও প্রয়োজন নেই। সেখানে আগে থেকে উপস্থিত থাকা শেখ মুজিব আমাদের দাবির পক্ষ নিয়ে কথা বলেন। এটাই আমাদের আকৃষ্ট করে যে অন্য নেতাদের মধ্যে কেউ আমাদের সমর্থন করছেন। দাবির পক্ষে সমর্থন জানানোর পাশাপাশি আমরা যেন নেতাদের সঙ্গে বেয়াদবি না করি সেটাও খেয়াল রাখছিলেন তিনি। যদিও আমরা ওইদিন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে এক ধরনের বেয়াদবি করে ফেলি। ছাত্রনেতা ছিলাম তো।
১৯৬৪ সালের দাঙ্গার সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ হয় উল্লেখ করে সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তখন ডাকসুর ভিপি। দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনের সময় এখনকার পল্টনের মেহেরবা প্লাজায় তখনকার ন্যাপের কোষাধ্যক্ষ সাইদুল হকের অফিস ছিল। ওই অফিসে সর্বদলীয় একটা সভা হয়। সভায় ডাকসুর ভিপি হিসেবে আমিও উপস্থিত ছিলাম। সেই সভা থেকে মুজিব ভাইকে দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনের আহ্বায়ক করা হয়। তখন তার কাছে আমাদের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা পেতাম। ওই সময় তার সঙ্গে বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। এরপর তো ৬৪ সালে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হই এবং ৬৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত জেলেই ছিলাম।’
জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধুর বার্তা বহনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘৬৭ সালে জুলাই অথবা আগস্ট মাসে আমি যখন আবার জেলে যাই তখন আমাকে রাখা হয় নতুন ২০ নম্বর সেলে। এবার দেওয়ানি ছিল ঠিক পেছনে। ওই সেলে আমি, নূরে আলম সিদ্দিকী, হাজী দানেশসহ অনেকেই ছিলাম। তখন বঙ্গবন্ধুর নামে আগরতলা মামলাসহ অনেক মামলা ছিল। আমার নামেও ৮টা মামলা ছিল। এসব মামলায় হাজিরা দেওয়ার জন্য সপ্তাহে ৪ দিন কোর্টে আসতে হতো। দেওয়ানি থেকে বঙ্গবন্ধুর বাইরে কোনও খবর দেওয়ার প্রয়োজন হলে তিনি আমার সেলে আসতেন। তিনি জেলের সবখানে যেতে পারতেন। তাকে কেউ বাধা দিতো না। যদিও তিনি তা সবসময় করতেন না। উকিল বা আওয়ামী লীগের কোনও নেতাকে কোনও বার্তা দিতে বা কিছু বলার থাকলে আমাকে বলতেন। আমিও কোর্টে হাজিরা দিতে যখন আসতাম তখন তাদের বঙ্গবন্ধুর সেই বার্তা দিয়ে যেতাম। এভাবেই জেল থেকে তার খবর আনা-নেওয়ার কাজটা করতাম।’
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জেলে ঈদ করার স্মৃতি তুলে ধরে রাশেদ খান মেনন বলেন, তখন জেলখানায় ঈদের নামাজে সব বন্দিকে নিয়ে আসা হতো। ঈদের জামাতে যাওয়ার সময় তিনি সারাটা পথ আমার কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলতে-বলতে গেলেন। কাঁধে হাত রেখে ঠিক তিনি এইভাবেই কথাটা বললেন, ‘দেখ, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তোরা তো জানিস আমি এই ধরনের ষড়যন্ত্রে বিশ্বাস করি না।’ তখন কিন্তু আগরতলা মামলা পুরোপুরি পাকিয়ে উঠেছে। এরপর তো তাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়।’
এটা কত সালের ঘটনা জানতে চাইলে ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি বলেন, ‘এটা ৬৮ সালের ঘটনা। ৬৭ সালে আমি গ্রেফতার হয়ে জেলখানায় যাই, বের হই ৬৯ সালে। আমি জেলখানা থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি বের হই। আর বঙ্গবন্ধু ২২ ফেব্রুয়ারি। এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই মঞ্চে সাবেক ছাত্রনেতা হিসেবে আমিও ছিলাম।’
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ৭২ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম দেখা হয় উল্লেখ করে রাশেদ খান মেনন বলেন, ৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সামরিক আদালতে আমার বিরুদ্ধে ৭টি মামলায় সাজা হয়। আমি তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাই। এরপর তো আত্মগোপনে ছিলাম। ৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে যাই। জহির রায়হানের গাড়িতে করেই স্টেডিয়ামের কোণায় আমরা ভাষণ শুনি। এরপর তো মুক্তিযুদ্ধ করলাম। আবার ৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ফেরার দিন যেতে পারি নাই। আমরা তখন কিছুটা সাইড হয়ে যাই। তখন আওয়ামী লীগ বড় দল হয়ে যায়। আমাদের মতো ছোট দলকে তারা পাত্তা দিতো না। যাই হোক, ৭২ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার আবার দেখা হয় ধানমন্ডির ১৮ নম্বরের ওই দোতলা বাড়িতে। সেখানেই বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখেই বলেন, ‘আয় তোরা, স্বাধীনতা এনেছি, সমাজতন্ত্র করবো।’
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন