রোগী নাজমা বেগমের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চিকিৎসক আলট্রাসাউন্ড করার জন্য বলার পর থেকেই ছয়টি বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিই। কিন্তু তারা বলেছেন, কেবলমাত্র ইমার্জেন্সি সার্ভিস রয়েছে, কোনও টেস্ট করানো হবে না।’ অবশেষে বন্ধু থাকার কারণে সাত নম্বর হাসপাতালে গিয়ে মায়ের আলট্রাসাউন্ড করাতে পেরেছেন জান্নাতুল।
জান্নাতুল বলেন, ‘পেট থেকে পাঁচ লিটারের মতো পানি বের করা হয়েছে। কী কষ্টটাই করেছে! উঠতে পারে না, বসতে পারে না, কেবল একটু আল্ট্রাসাউন্ডের জন্য।’
যে বেসরকারি হাসপাতালে মাকে নিয়ে তিন দিন ছিলেন জান্নাতুল সেখানকার অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘বড় কোনও ডাক্তারই হাসপাতালে আসেন না। অন রিকোয়েস্টে কেবলমাত্র গাইনি বিভাগের কয়েকজন চিকিৎসক আসেন সিজারিয়ান কেস হ্যান্ডেল করতে। বাকিরা কেউ আসছেন না। কেবলমাত্র আইসিইউয়ের রোগীদের রাখা হয়েছে। পুরো হাসপাতাল জুড়ে সুনসান। কেউ নেই।’
এদিকে, বেসরকারি চাকরিজীবী আতিয়া অর্পার দাদুর বয়স ছিল ৭৯ বছর। কিডনি আর হার্টের সমস্যা ছিল। গত ২২ মার্চ সারাদিন তিনটি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে চার নম্বরে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে (ডিপার্টমেন্টের প্রধান করোনা হয়নি নিশ্চিত করার পর ভর্তি নেওয়া হয়)। এরপর অবস্থার অবনতি দেখে রাত ১২টায় জানিয়ে দেয় তারাও রাখতে পারবে না, এরপর ৫ নম্বর হাসপাতালে নিয়ে মধ্যরাতে ভর্তি। ভোরে অবস্থার অবনতি।এরপর লাইফ সাপোর্ট। অতঃপর সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে মারা যান লুৎফুন্নাহার।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি নিচ্ছে না, চিকিৎসকরা বসছেন না– এমন অভিযোগ রোগী এবং স্বজনদের। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ এপ্রিল রাজধানীর পান্থপথ, গ্রিন রোড ঘুরে দেখা যায়– যে গ্রিন রোডে পা ফেলার জায়গা থাকে না। ডাক্তারের সিরিয়াল সন্ধ্যা ৭টায় থাকলে মগবাজার থেকে বের হতে হয় সাড়ে ৪টায়। সেই গ্রিন রোডে কোথাও কেউ নেই। হাসপাতালের সামনে নেই নিরাপত্তারক্ষীদের হুইসেল, নেই গাড়ির জটলা।
গ্রিন রোডের গ্রিন লাইফ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতলে গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটকে তালা মারা। ভেতর থেকে সাইনবোর্ড ঝুলছে ‘ক্লোজ’। ভেতরে তিনটি লিফটের সিরিয়ালে জায়গা পেতে যেখানে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। কয়েকবার লিফট উপর-নিচ করার পর সুযোগ হয় ওঠার। সেই লিফটের কয়েক হাত দূর থেকে লেখা ‘ভিজিটর পাস ছাড়া হসপিটালে প্রবেশ ও অবস্থান নিষেধ’। রিসেপশনের সামনে যেখানে রোগীদের দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করতে হয়, সেখানে চেয়ারগুলো শূন্য পড়ে আছে। রিসেপশনের চারপাশে পর্যন্ত আটকে দেওয়া হয়েছে। সব ফাঁকা কেন জানতে চাইলে রিসিপশন থেকে বলা হয়, স্যাররা ছুটিতে আছেন।
একটু এগিয়ে ল্যাবএইড হাসপাতাল। অ্যাম্বুলেন্স, ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজির ভিড়ে যেখানে রোগী নামাতে একটু দেরি হলেই নিরাপত্তারক্ষীদের লাল চোখ দেখতে হয়, সেই হাসপাতালের সামনে দুটি অ্যাম্বুলেন্স আর দুটি ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অলস সময়ে রাস্তার ধারে চা খেতে দেখা যায় নিরাপত্তারক্ষীদের।
বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে রোগী নেই। এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা মিলছে না বলে তারা অভিযোগ পাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, ক্লিনিক এবং প্রাইভেট চেম্বারগুলো অনেকাংশে বন্ধ আছে। এই সময় পিছপা হওয়াটা যুক্তসঙ্গত নয় মন্তব্য করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আমরা পিছপা হবো না।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, মূলত রোগীর অভাবেই তাদের হাসপাতালের কার্যক্রম সীমিত হয়েছে।
হাসপাতালে রোগীর ভিড় নেই স্বীকার করে নিয়ে ল্যাবএইড হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এমএ শামীম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘করোনার এই দিনে রোগী-চিকিৎসক উভয় পক্ষই ভয় পাচ্ছেন। রোগীও আসছেন না, চিকিৎসকও কমে গেছে।’
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘রোগীরা ভয় পাচ্ছেন কোনও করোনা আক্রান্ত থাকলে তার থেকে সংক্রমিত হতে পারেন। তাই পারত পক্ষে কেউ বাসা থেকে আসছেন না। একইসঙ্গে রাস্তা ফাঁকা, পরিবহনের সমস্যাও রয়েছে। অন্যদিকে একজন রোগী করোনা আক্রান্ত কিনা সেটা যেহেতু চিকিৎসক জানতে পারছেন না তাই চিকিৎসকরাও রোগী দেখছেন ভাগ করে। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আতঙ্ক কাজ করছে সবার ভেতরেই। তাই হাসপাতালে রোগী কম।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রাইভেট হসপিটাল, ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের জেষ্ঠ্য সহসভাপতি ও শমরিতা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এবিএম হারুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিটি জরুরি বিভাগই যথাযথভাবে প্রস্তুত, কিন্তু রোগী নেই।’
এদিকে, চিকিৎসক নেতা ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে। এ সমস্যার সমাধান হবে শিগগিরই।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা কাজ করছি, সমাধান হয়ে যাবে।’