‘বীরাঙ্গনা উপাধি’ আমাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে

নারী মুক্তিযোদ্ধা৬১ বছর বয়সী মায়া(ছদ্মনাম)। ধপধপে সাদা শাড়ি পরিপাটি করে পরা। চোখে চশমা। কিন্তু চোখ ভাবলেশহীন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় রংপুর টাউন হল টর্চার সেলে ১০ দিন বন্দি ছিলেন। শেষ দশদিন আগে তাকে ধরে আনায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু এই ‘প্রাণে বেঁচে’ যাওয়া জীবন আজীবনের জন্য মেরে রেখেছে তাঁকে। তিনি কখনও কোথাও তার জীবনের কথা খুলে বলেননি। ভাইয়ের বাসায় জীবন কাটিয়ে দিলেন এই ক্ষোভ থেকে যে, তাদের বীরাঙ্গনা বলে পরিচয় করিয়ে না দিলে জীবনটা অন্যরকম হতো। তার মতে, এদেশে বীরাঙ্গনা শব্দটা কখনওই ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করা হয়নি। এ অবস্থায় বাংলা ট্রিবিউন আয়োজিত ‘বিজয়ের গল্প’ বিভাগে টর্চার সেলে থাকার অভিজ্ঞতা কথা শোনাতে তাঁর কাছে সবিনয় অনুরাধ করা হয়। তিনি তা শোনালেন, তবে অনুরোধ একটাই- তার পরিচয় যেন কেউ জানতে না পারেন।

-আপনি কখনওই কাউকে বলেননি সেসময় কী দেখেছেন, আপনার ওপর কী ধরনের নির্যাতন হয়েছে সেসব কথা। কেন?

কাউকে বলিনি সেসব কথা। কিন্তু আমার ওপর নির্যাতনের কথা আমার ভাই জানতেন। তিনি মারা গেছেন। কাউকে না বলতে এবং কোনও উপায়েই কারও সামনে নিজের পরিচয় উন্মোচন যেন না হয় সেজন্য এলাকা ছেড়েছি আজ ৪৪ বছর। আর গ্রামে ফেরা হয়নি। কিন্তু কাকে বলব এই যন্ত্রণার কথা। সেসময় মরে গেলে ভালো হতো। কিন্তু বেঁচে বের হয়ে আসার পর যখন আমাদের বীরাঙ্গনা পরিচয় দেওয়া হলো, তখন দেখলাম- বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হলো না, এর মানেই হলো আমার দিকে আঙুল তুলে মানুষ বলবে আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তাই কাউকে বলিনি কখনও। যারা আমাকে চিনতেন তাদের কাছে যাইনি কখনও। মূলত এই ‘খেতাব’ আমাকে সমাজ ও জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।

-কিন্তু সেখানে কী ঘটেছিল সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তো এ প্রজন্মের জানার কথা না। সেজন্য আমাদের যদি জানিয়ে রাখতেন।

কথাগুলো বলতেই যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠল মায়ার মুখ। তিনি কিছু সময় নিয়ে বলে চললেন- আমাকে যখন নেওয়া হয়, ডিসেম্বরের শুরুতে তখন সেখানে শ’ খানেক মেয়ে ছিল, এটুকু মনে আছে। কেউ কারওর সঙ্গে মনের কথাটাও বলতো না। কারওর সঙ্গে খেতো না। কেবল গুমরে ওঠা কান্নার আওয়াজ। মাথা ঠুকে রক্তে লাল করে ফেলেছে দেয়াল। আমাকে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে থাকা একজন রক্তাক্ত শরীরে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন, তুমি তো খুব সুন্দর। তারপর আর কোনও কথা হয়নি তার সঙ্গে। সেই রাতই ছিল তার শেষ রাত। পাকিস্তানিরা দুইমাস আটকে রেখে গণধর্ষণ চালিয়েছিল তার ওপর। সেই রাতে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো ঘর থেকে। পাশের রুম থেকে যন্ত্রণায় তার গোঙানির শব্দ পেয়েছি শুধু, আর ভয়ে সিঁটিয়ে থেকে ভেবেছি কখন আমারও ডাক আসবে। গণধর্ষণের যন্ত্রণা সহ্য না করতে পেরে সেই রাতেই তিনি মারা যান। তার কাপড়হীন শরীরে ছুড়িকাঘাত করা হয়। নখের ওপরের অংশ উপড়ে ফেলতে ফেলতে ধর্ষণ উদযাপন চলে। তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত যেনে তাকে ফেলে আসা হয় পাশে থাকা শুকনো কুয়াতে।

এটুকু বলে মায়া প্রায় আধা ঘণ্টা আর কোনও কথা বলতে পারেননি। কেবল দুচোখ বেয়ে অঝোরে নিঃশব্দ পানি নেমে আসে। থিতু হয়ে তিনি বলেন, আমি যখন দেখতাম সন্তানসম্ভবা মেয়েদের ভোগের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন কয়েকবার ভেবেছি, আমাকে নিয়ে গেলেও পারে। এই মা হতে চলা মেয়েরা অন্তত বাঁচতো। তারপর আমার দিনও এলো। ধরে নিয়ে আসার পরের দিন আমাকে ছেড়ে দেওয়া হলো ৫ পাকিস্তানির হাতে আর এক রাজাকার দাঁড়িয়ে ছিল সেই ঘরে। বিশ্বাস করেন, ৫ পাকিস্তানির প্রতি আমার তত ঘৃনা জমেনি যতটা সেই রাজাকারের জন্য, যে কিনা আমারই পাড়ার মানুষ, আমারই দেশের মানুষ। নির্যাতন শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে আমি জ্ঞান হারাই। যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন টের পাই একজন জ্ঞান হারানো মানুষকেও তারা নিস্তার দেয়নি, উল্লাস চালিয়ে গেছে। পরে দুজন ধরে এনে আমাকে অন্যরা যে ঘরে আটকানো ছিল সেখানে দিয়ে গেল।

আমি যখন নির্যাতনের শিকার হলাম তারপরই সেখানে আগে থেকে থাকা মেয়েরা আমার সামনে মুখ খুললো। তার আগের সময়টাতে তারা কেউ আমার সঙ্গে কথা বলেনি। সবাই ভয় পেত, কেউ নতুন কাউকে বিশ্বাস করতো না। পরে আমি তাদের কাছ থেকে অনেক কথা শুনেছি।

আমাদের কাছে কোনও ভারী কিছু রাখা হতো না। এমন কিছু যা দিয়ে আমরা নিজেদের প্রাণ নিতে পারি তেমন সুযোগ ছিল না। কিন্তু আমরা পরস্পরের গলা চিপে মেরে ফেলার পরিকল্পনাও একসময় করি। আমাদেরই একজন দাত দিয়ে তার আঙুল অর্ধেক করে ফেলেছিল। সে কি রক্ত! সেই রক্ত দিয়ে দেয়ালে দেয়ালে আমরা লিখেছি, মুক্তি চাই। আমাদের বাঁচাও। আমাদের কেউ বাঁচাতে পারেনি। শেষে বিজয়ের পরের দিন আমরা বের হয়ে আসি। তখন আমরা হাঁটতে পারছিলাম না, অন্ধকারে থাকায় আলোতে এসে চোখ খুলতে পারছি না। কানে শুধু আসছে মুক্তিযোদ্ধাদের জয় বাংলা। কী করবো কোথায় যাব ভাবছি, চিৎকার দিয়ে কাঁদছি, এসময় কানের কাছে কেউ একজন বলল, মায়া চল। গলা শুনে বুঝলাম আমার বড়ভাই। সেখান থেকে তিনি আমাকে তার বন্ধুর গ্রামের বাড়ি নিয়ে গেল। সেখানে তার ডাক্তার বন্ধু আমার শরীরের ক্ষতস্থানের চিকিৎসা করেন। কিন্তু মনের ক্ষত?

-এরপর কী হলো?

এরপর আর কী হবে। সেই বাড়িতে কিছুদিন থেকে একটু সুস্থ হয়ে আমরা রওনা দিলাম ঢাকার পথে। তখনও আমরা সবাই ভয় পাই। নিজেদের মনের ভেতর স্বাধীন হওয়ার আনন্দ উপভোগ করতেও ভয় কাজ করছে। আমার ভাই শুধু বললেন, কাউকে তুমি তোমার কথা বলো না। নতুন জীবন শুরু করো। মনের ক্ষত দূর তো হবার না। শরীরের ক্ষত শুকিয়ে যাচ্ছে যখন, তখনই টের পেলাম আমি সন্তানসম্ভাবা। কিশোরী হিসেবে আমার করণীয় কী ছিল ঠিক করতে পারিনি, কিন্তু অভিভাবক হিসেবে ভাই ঠিক করলেন বাচ্চা নষ্ট করে দেওয়ার, সেটাই হলো। কিন্তু সেই যন্ত্রণায় আমি আর নতুন করে কিছুই শুরু করতে পারিনি। কেবল দেখলাম স্বাধীন দেশে কী করে নির্যাতনের শিকার নারীদের ধর্ষিতা পরিচয়কে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। আমি যে বীরাঙ্গনা সেটা প্রাণ খুলে না বলতে পারার একমাত্র কারণ- আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে বীরাঙ্গনা মানেই তার ওপর কতজন নির্যাতন করেছে সেই কথাটাই মাথায় আগে আসা।

-কিন্তু অনেকে তো বীরাঙ্গনা বলছেন?

তাদের হয়তো অনেক সাহস। বা তাদের হয়তো পাশে কেউ দাঁড়িয়েছে। ১৬ বছরের আমি তখন তত সাহস দেখাতে পারিনি। কেবল সারাজীবন নিজেকে লুকিয়েই রাখলাম। এখন একটা মরা শরীর নিয়ে বেঁচে আছি কবে দাফন হবে সেই অপেক্ষায়।

/এএইচ/আপ-এনএস/