জার্নি টু ওয়ার: সামনে মৃত্যু, কণ্ঠে জয় বাংলা

রাইসুল ইসলাম আসাদরাইসুল ইসলাম আসাদ—আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতা।  বেতার, মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে সমানতালে অভিনয় করে চলেছেন দীর্ঘ সময় জুড়ে। কেবল দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক  অঙ্গনেও এই শিল্পীর অভিনীত চলচ্চিত্র বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে। অভিনয় শিল্পে অসামান্য অবদানের জন্য পেয়েছেন একাধিক জাতীয় পদক-পুরস্কার।

রাইসুল ইসলাম আসাদের জন্ম ১৯৫২ সালের ১৫ জুলাই, ঢাকায়। ছিলেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র। ১৯৭১ সালে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে যখন ডাক পড়লো, তখন মুক্তিকামী  বীরসেনানীদের সঙ্গে তিনিও ঝাঁপিয়ে পড়লেন  মুক্তিযুদ্ধে।

মহান মুক্তযুদ্ধের এই অকুতোভয় গেরিলা যোদ্ধা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়া, বাংলাদেশে যুদ্ধপ্রস্তুতি, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে।

মুক্তিযুদ্ধে গেলেন কিভাবে?

গেলাম কিভাবে—সেই সব ইতিহাস। আজ সেই জার্নিটাই বলতে চাই। যুদ্ধের সময় খালি ফাইট করলাম, গোলাগুলি হলো, বেঁচে আসলাম বা মরে গেলাম তা নায়, পুরো যুদ্ধের শুরুর এবং চলাকালীন ব্যবস্থাপনাটাই মূল বিষয়। তারপর না আমরা অপরাশেন করার উপযোগী হলাম। সেই জার্নিটায় সার্বক্ষণিক মৃত্যু নিয়ে চলতে হয়, সেখানে মৃত্যুটা কোনও ফ্যাক্টর নয়। 

আমার জন্ম এই পুরান পল্টনেই। পাশের বাসার নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুরা ৬ ভাই, আমরা ৫ ভাই। ছাত্র আন্দোলন থেকে গণআন্দোলন সবকিছুতেই ছিলাম। আমরা এতগুলো যুবক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সচেতনতা নিয়ে বেড়ে উঠেছি, সেটার একটা প্রভাব তো ছিলই।

কখন ঠিক করলেন যুদ্ধে যেতে হবে?

২৫ মার্চ। আমরা প্রতিরোধে রাস্তায় নেমেছিলাম। কিন্তু প্রস্তুতিহীনতায় একসময় সরে আসতে হলো। এরপর রাত থেকে শুরু হলো হামলা। ২৭ তারিখ কিছুক্ষণের জন্য যখন কারফিউ তোলা হলো, তখন আমি দেখতে বের হলাম। ইংলিশরোড পুরোটা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, লক্ষ্মীবাজার, তাঁতীবাজার—সব এলাকা শেষ। ৮ নম্বর শাঁখারী বাজারে আমার এক স্কুলবন্ধু থাকতেন। ওই এলাকার বাড়িগুলোর চারপাশে ঘর, মাঝখানে পাকা উঠোন। ওদের বাড়ির উঠানে দেখি লাশের স্তূপ। লাশ টেনে-টেনে সরিয়ে তাকে খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম।

এর পরের দিন থেকেই আমাদের এলাকা ছেড়ে সবাই নদীর ওপারে চলে গেল। ১ এপ্রিল মুরব্বিরা জোর করে ওখানে নিয়ে গেলেন আমাকেও। একেকটা বাড়িতে ৬০-৭০জন থাকা। ১ তারিখ নিয়ে গেল, ২ তারিখ সকালে পাক আর্মি আক্রমণ করল ওই এলাকায়। পাখির মতো গুলি খেয়ে মরছে মানুষ। কয়েকঘণ্টা পর বের হয়ে দেখি, লাশ আর লাশ।

পালিয়েও নিরাপত্তা নেই বুঝে সে দিনই বিকেলে আমরা পল্টনে ফিরে এলাম। আমরা বুঝলাম, এখন আর কোনও উপায় নেই, প্রতিরোধ করতে হবে। কিন্তু কিভাবে সেই পথ পেলাম না। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম ঘুরে বাচ্চু এসে বলল আগরতলায় ক্যাম্প তৈরি হচ্ছে, সেখানে যেতে হবে। আমি, বাচ্চু, বেবি বাসায় অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে গেলাম।

আগরতলার পথে?

হ্যাঁ। কমলাপুর থেকে বাস ছাড়ত। আমরা চান্দিনা পর্যন্ত বাসে গিয়ে রিকশা দিয়ে সীমান্তের কাছে এক পরিচিত ব্যক্তির বাসায় যাব। ইলিয়ডগঞ্জের ওখানে ব্রিজের ওপারে বাস যাবে না। এপারে নেমে ওপার থেকে আরেকটা বাসে উঠতে হবে। ব্রিজের ওপর আর্মি। আমরা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলাম এবং তিনজন যে একসঙ্গে, সেটা যেন কেউ না বুঝতে পারে, সেভাবেই এলাকা পার হয়ে রিকশা নিলাম। অমুক জায়গা যাব বলতেই রিকশাচালক জানালেন, যে গ্রামে যাব ভেবেছিলাম, আগের দিন রাতে সেই গ্রাম ছারখার হয়ে গেছে পাকিস্তানি আর্মির হামলায়। আমরা যুদ্ধ করতে বের হয়েছি জেনে রিকশাওয়ালা এরপর বিকল্প পথ দেখালেন। প্রথমে রেললাইন, তারপর ঘন পাহাড়ি জঙ্গল, তারপর পাহাড় থেকে নেমে ওপারে ভারত। কিভাবে ওই রাস্তা পাড়ি দিয়েছিলাম, বলতে পারব না। কিন্তু পৌঁছলাম। তখন আগরতলা বাংলাদেশিতে ভর্তি।

সেখানে কি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন?

কিসের প্রশিক্ষণ। ওখান থেকে আমাদের কলকাতা পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সে কি দুরবস্থা! ট্রেনে যেতে হবে। সেখান থেকে সবচেয়ে কাছের স্টেশন ধর্মনগর, তাও ১৩৮ কিলোমিটার দূরে। স্টেশনে গিয়ে দেখি, শুধু শরণার্থী, পিঁপড়ার মতো মানুষ আর মানুষ। ট্রেন দেখা যাচ্ছে না। দৌড়াদৌড়ি করে জানলাম এখনই একটা ট্রেন ছাড়বে।কোনওমতে আমরা হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে কিছুদূর গিয়ে বুঝলাম, এভাবে যেকোনও সময় ছিটকে পড়ে যাব। বাচ্চুর বুদ্ধিতে ট্রেনের ছাদে উঠলাম। কিন্তু ভারতের ট্রেনে বসার সুযোগ নেই, ঢালু। সেখানে গামছা দিয়ে চিমনির সঙ্গে নিজেদের বেঁধে রেখে রাত পার করলাম। এভাবে আর থাকতে না পেরে একটা স্টেশনে নেমে গেলাম। সেখানে একদিন থেকে আরেক ট্রেনে উঠে ফারাক্কা থেকে স্টিমারে কলকাতা পৌঁছালাম।

সেখানে গিয়ে খবর পেলাম, পশ্চিম দিনাজপুরের মধুপুর গ্রামে একটা ক্যাম্প আছে, যারা ঢাকার ছেলেদের নিয়ে একটা দল বানাতে চায়।সেটার দায়িত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের জলিল সাহেব। আমাদের ট্রেনিং দেওয়া হলো। সীমান্তের কিবরিয়া স্যারের কাছে থ্রি-নট-থ্রি স্টেনগান, এলএমজি চালানো শিখলাম, ফ্রি হ্যান্ড কমব্যাট, এক্সপ্লোসিভের প্রশিক্ষণ। আমি আর বাচ্চু অংকে ভালো ছিলাম বলে এক্সপ্লোসিভ ট্রেনিং বেশি দেওয়া হলো।

যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত আমরা। ট্রেনিং যখন শেষ পর্যায়ে তখন অভিনেতা জাফর ইকবাল ও জামাল নামে একজন রওনা হলেন ঢাকায় পথে। আমাদের দলটি কোনপথে আসবে, সেসব পকেট তৈরি করতে। তারা ফিরলেই যুদ্ধে যাব আমরা। তারা আর ফিরলেন না, এরই মধ্যে সেক্টর ভাগ হয়ে গেল। তখন ঢাকা যেহেতু সেক্টর-২-এ পড়ল, সেখানে যেতে হলে আগরতলার অনুমতি নিয়ে যেতে হবে বলে ওখান থেকে আমাদের আগরতলা পাঠানো হলো।

আবার আগরতলা! ওই পথেই?

হ্যাঁ, কথামতো আগরতলার মেলাঘর ক্যাম্পে পৌঁছলাম চারদিনে। শরীর ভেঙে পড়েছে। খাওয়া কেবল রুটি আর লাবড়া। তাও বালি ‘কিসকিসে’। ওখানে অনেক পরিচিতকে পেলাম, যারা ফ্রন্টে ফাইট শুরু করেছেন। ওরা খাওয়ার একটা সিস্টেম জানালেন। খাওয়ার আগে দুটা ধানি মরিচ চিবিয়ে খেলে ঝালে জিহ্বা অসাড় হয়ে যেত। তখন যা খুশি মুখে দিয়ে গিলে ফেললেই হয়। সেভাবেই চলল।

ওখানে আমাদের খালেদ মোশাররফ সাহেব বললেন, আমাদের আবার ট্রেনিংয়ে যেতে হবে। ভারতের আর্মির প্রশিক্ষণ না নিলে অস্ত্র পাওয়া যাবে না। আমরাসহ ৫২জনের একটা টিম করা হলো। আমরা শুরুতে না যেতে চাইলেও পরে নিয়ম যা, তা মানতে যেতেই হলো।

আপনারা গেলেন কতদিনের জন্য?

ওখানে গিয়ে আমাদের হলো, আরেক ঝামেলা। তারা যেটা শেখায়, তার সঙ্গে আমাদের আগের প্রশিক্ষণ মেলে না। কিছুতেই মেলে না। এ সময় মেজর ঝা নামের একজন দ্বিতীয় দিনে আমাদের টার্গেট প্র্যাকটিসের পরীক্ষা নিতে চাইলেন। একটা সিঙ্গেল গুলি আর ব্রাশফায়ার। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের যে প্রবল ইচ্ছাশক্তি সেটা দেখেই আর কোনও প্রশিক্ষণ নিতে হবে না জানিয়ে দিলেন। এরপর ক্যাম্পে ফিরে আমাদের দেশে ঢোকার সময় এলো। ঢুকতে গিয়ে পাকিস্তান আর্মির অ্যাম্বুসে পড়েছিলাম। তিতাস নদীতে রেলওয়ে ব্রিজ ও সিএনবি রোডব্রিজের মধ্যে। অনেক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হারাই আমরা সে দিন।

তিতাস নদী দিয়ে প্রবেশে যে বাধার মুখে পড়লেন সেই ঘটনাটা কিরকমভাবে সামলেছিলেন?

আমাদের ইনফর্মার হিসেবে কাজ করতেন পাটবোঝাই নৌকার মাঝিরা। ব্রিজগুলোর ওপর রাতে রাজাকাররা পাহারা দেয়। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার সাজিয়ে সেই পাহারায় বসানো হয়েছিল। তারা যখন দেখতেনদ, পাকিস্তান আর্মি আশেপাশে নেই, তখন পাকিস্তানের পক্ষে নানা স্লোগান দিতেন আর মাঝিরা সিগন্যাল বুঝে যেতেন। তো সে দিন পাকিস্তান আর্মি নেই এমন তথ্য এলো। আমরা জানতাম না পাকবাহিনী আমাদের এই সিগন্যাল ব্যবস্থা টের পেয়ে গিয়েছিল এবং পাহারায় থাকা সবাইকে হত্যা করে ব্রিজে অবস্থান নিয়েছিল।

তিতাস নদীর পাড়ে অপেক্ষা করছি, রাতের বেলা নদীর বাঁকে রাখা নৌকায় উঠে রওনা দেব। ফরিদপুরের একটা দল ছিল আমাদের সঙ্গে, তারাসহ আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আগে যেতে চাইলেন। আমরা ৫২জন ঠিক করলাম ঠিক আছে, পরে যাই। ওদের নৌকা রওনা দিয়ে প্রথম ব্রিজটা পার হয়ে দ্বিতীয় ব্রিজের কাছাকাছি যেতেই দুপাশ থেকে দুব্রিজে থাকা পাকবাহিনী হামলা করে। আর যদি ভারতের আর্মি এই নৌকাগুলোকে ব্যাক দেয়, এটা ভেবে আমাদের দিকেও গোলা ছুড়ছে। সেদিন আমরা অনেক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার লাশ নদীতে ভেসে যেতে দেখে ফিরে আসলাম ক্যাম্পে, মেলাঘর ক্যাম্প থেকে একটু দূরে।

যারা মারা গেছেন, তাদের অস্ত্রসহ আমরা ফেরত আসলাম। হায়দার সাহেব খালেদ মোশাররফ সাহেব এসে জানালেন সিগন্যাল পেলে আমরা আবার রওনা হব। বাচ্চু বললেন, আমাদের নিজেদেরই পথ বের করতে হবে। আমরা রওনা দিলাম। সাভারে নদীর পাড়ে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর এলাকায় আমাদের ওঠার কথা। আগরতলা থেকে নদী পথে সাভার। সারাদিন আমরা থাকতাম পাটাতনের নিচে। দেড়দিন কোনও খাবার ছিল না, যেটুকু ছিল মাঝিদের জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে। এভাবে আমরা সাভার পৌঁছলাম। এরপরের কথা মানে ঢাকায় অপারেশনের কথা তো সবার জানা। বইতে আছে।

একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে একাত্তরের বাংলাদেশ ও এখনকার সময় নিয়ে কী ভাবেন?

বাঙালি খুব তাড়াতাড়ি অতীত ভুলে যায়। আমি দেখেছি, কিভাবে মানুষ যুদ্ধের কয়েক বছর পরেই চোখ উল্টে ফেলেছে। আমরা যারা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছি, তাদের ছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রত্যাশা। এখন মানুষ দেশের জন্য কিছু করছে সেটাই শোনা যায় না। ভুলে গেলে চলবে না, মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন গ্রামের হাল চালানো কৃষক। যুদ্ধ শেষে অস্ত্র ফেলে আবার হাল ধরেছেন। দেশপ্রেম-দেশের স্বার্থ ছাড়া তাদের আর কোনও স্বার্থ ছিল না।

ছবি: নাসিরুল ইসলাম

/এমএনএইচ/আপ-এসএম