পঙ্গু ছেলেকে নিয়ে বীরাঙ্গনা বিভারানীর জীবনযুদ্ধ

দেশকে শত্রুমুক্ত করতে ১৯৭১ সালে নিজের সম্ভ্রম দিয়ে তার যুদ্ধের শুরু। তবে স্বাধীনতার ৪৪ বছরে এসেও বীরাঙ্গনা বিভারানীর সেই যুদ্ধ যেন শেষ হয়নি। স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে পঙ্গু ছেলে সাগরকে নিয়ে আজও তিনি লড়ে চলেছেন জীবনযুদ্ধ।

বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার টরকী বন্দরের পাশে বাবা উমেশ চন্দ্রের আড়াই কাঠা জমিতে টিনের ঘরে বাস করেন বিভারানী। একমাত্র ভাই উপেন্দ্র নাথ মণ্ডলকে নিয়ে বিভারানী সেখানে কাপড় সেলাই করেই এখন সংসার চালান। সংসারের চাকা সচল রাখতে মাঝে মাঝে ধাত্রীর কাজও করতে হয়।

মুক্তিযুদ্ধের পর বীরাঙ্গনা হওয়ার ‘দোষে’ স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যান। জীবনযুদ্ধের কঠিন বাস্তবতায় বৃদ্ধা বিভা রানী এখন একাই তার নিশ্চল সন্তানকে নিয়ে অসহায়ত্বের সঙ্গে লড়ছেন। এখন দেশের কাছে তার কেবল একটাই দাবি, পঙ্গু সন্তান নিয়ে যেন তিনি একটু ভালোভাবে বাচঁতে পারেন।

সম্প্রতি কথা হয় বিভারানীর সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসতেই তিনি অনেকটা আনমনা হয়ে যান। এরপর বলতে থাকেন সেসময়ের কথা।  তিনি বলে ওঠেন, ‘আমার বাবা টরকীর চরে বহুদিন ধরে বসবাস করতেন। সেখানে তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন। আমরা ছিলাম চার বোন এক ভাই। ১৯৭১ সালে আমি টরকী হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিলাম। জৈষ্ঠ্য মাসে  এখানে পাকিস্তানি মিলিটারিদের নিয়ে আসে রাজাকাররা। তারা চারিদিকে আগুন দিতে শুরু করে। লোকজন যে যেদিক পারে ভয়ানক ভাবে ছোটাছুটি করছিল। আমার বাবা তখন পর্যন্ত বাড়িতেই ছিলেন। সবাই বাবাকে বাড়ি ছেড়ে পালাতে বললে তিনি আমাদের নিয়ে কালকিনির রমজানপুরের দিকে নিয়ে ছুটলেন। কিন্তু তখন যে যেদিকে পারি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিলাম।’

‘আমিসহ বেশ কিছু মেয়ে আখ ক্ষেতের মাঠে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে গলাম। সেদিন এদের হাত থেকে কেউ রেহাই পায়নি। আমি নির্যাতনের কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরবর্তীতে আমাদেরকে বাবা খুঁজে পেয়ে ঘরে নিয়ে যায়। টরকী এসে দেখি বন্দরটি পাকিস্তানি আর্মি সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দিয়েছে। বাবা দ্রুত শ্রাবণ মাসেই কাছের গ্রামের অনকুল মজুমদার নামে একজনের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দেন। 

এরপর আমরা দুই পরিবারের প্রায় ১০ জন টরকী থেকে নৌকায় আট দিন বাদুরপুর -ওড়াকান্দি- রামদিয়া কলেজ- হেলেঞ্চা হয়ে ওপারে বাগধা বর্ডারে পৌঁছালাম।’

‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবাই আবার দেশে আসলাম। কিন্তু আমার স্বামী হঠাৎ কিছু না জানিয়ে উধাও হয়ে যান। পরবর্তীতে তিনি ফিরে এলেও, ছেলে সাগর জন্মাবার চার মাস পর ১৯৮৮ সালে আবার  আমাকে ছেড়ে ভারতে চলে যান। ছেলে জন্মাবার সময়ে তার মাথায় একটি ক্ষতের সৃষ্টি হলে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ভুল চিকিৎসার কারণে সাগরের পা অনেকটা শুকিয়ে যায়। এছাড়া মাথায়ও সমস্যা দেখা দেয়। সেই থেকে এই পঙ্গু ছেলেকে নিয়ে আমার কোনও রকমে দিন কাটছে।’

বিভারানী আরও  বলেন,‘আমি আগে এছাহাক চেয়ারম্যান, জামাল মিয়ার সঙ্গে মিলে তাঁত ও লুঙ্গি বুনতাম।এখন অর্ডারে মেয়েদের কাপড় সেলাই করি। টরকী বন্দরে আমার সেলাই করা জামা কাপড়ের সুনাম আছে। মাঝখানে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবেও ১০ বছর কাজ করেছিলাম। সেই অভিজ্ঞতার কারণে আসেপাশে ধাত্রীর কাজ করে কোনও রকমে জীবন চালিয়ে যাচ্ছি।  আমার মতো নির্যাতনের শিকার আরও  বহু পরিবার আছে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে আমরা কোনও সাহায্য সহযোগিতা পাই নাই।’

ছেলের ব্যপারে তিনি বলেন, ‘এই ছেলেকে খাইয়ে দিতে হয়। আমি ছাড়া সে অচল। চলাফেরা করতে পারে না।  মাকে না দেখলে অস্থির হয়ে পড়ে। আমি না থাকলে তাকে কে দেখবে? আমারতো সব গেছে। এই ছেলের জন্য সরকারের কাছে আমি সাহায্য চাই।’

/এসএম/এফএস/