‘প্রচণ্ড দুর্গন্ধ, দম তুলতে পারি না’

cover-1তীব্র দুর্গন্ধ। প্রবাহিত হচ্ছে কালো পানি। ময়লা-আবর্জনার সঙ্গে মানুষের পয়ঃবর্জ্য মিশে একাকার। এরমধ্যেই ম্যানহোলে নেমে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে ড্রেনের তলদেশ পরিষ্কার করছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পরিচ্ছন্নতা কর্মী হাবিব। মাঝে মাঝে এই দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত পানিতে ডুব দিতে হয় তাকে। তুলে আনেন বালতিভর্তি মাটি-আবর্জনা। ওপর থেকে হাত বাড়িয়ে বালতি নেন সহকর্মী, ময়লা-আবর্জনা ঢেলে দেন ফুটপাতে। এই চিত্র রাজধানীর কাওরান বাজারে সার্ক ফোয়ারা সংলগ্ন সড়কের ফুটপাতের।

ডিএনসিসির পরিচ্ছন্নতাকর্মী  হাবিব বলেন, ‘প্রচণ্ড দুর্গন্ধ। ড্রেনের ভেতরে গেলে দম তুলতে পারি না। মাঝে মাঝে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় যেন পুরো পৃথিবীটা অন্ধকার। অনেক সময় ভয়ও লাগে। কারণ, ড্রেনের ভেতরে কত কিছু থাকে। এরপরও কাজ করতে হয়। আমাদের কোনও সিকিউরিটি নেই। দুর্গন্ধ রোধের কোনও ব্যবস্থাও নেই। যেখানেই ড্রেনে ময়লা জমে জ্যাম হয়ে যায়, সেখানেই নামতে হয়। রাতদিন কাজ করি। ছুটিও পাই না।’

কেবল হাবিবই নয়, এমন দুরবস্থা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সব পরিচ্ছন্নতাকর্মীর। তারা জানিয়েছেন, ঈদ উৎসব কিংবা যেকোনও দুর্যোগসহ বছরের প্রায় প্রতিদিনই তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। ঈদের দিনেও ছুটি পান না তারা। চরম ঝুঁকির মধ্যে কাজ করলেও তাদের নেই কোনও ঝুঁকিভাতা।

গত ২২ মে দক্ষিণ সিটির খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, গুলজার আহমেদ, বাহার উদ্দিন, জাহানারা বেগম ও রাম দাসসহ বেশ কয়েকজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী সড়ক পরিষ্কারে ব্যস্ত রয়েছেন। ব্যস্ততার ফাঁকেই কথা হয় তাদের সঙ্গে। বললেন, ‘স্যার, আমাদের খবর কেউ রাখে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাস্তায় থাকি। ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করি। ময়লার মধ্যে কাজ করার কারণে আমাদের অনেকেই ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। প্রতিবছর এভাবে অনেকে মারা যান। মানুষ হিসেবে সঠিক মর্যাদাও পাই না। মানুষ আমাদের ঘৃণা করে। কেউ একটু ভালোভাবে কথাও বলে না। অথচ আমরাই নগরীকে পরিষ্কার রাখি। মানুষের আবর্জনা আমরাই অপসারণ করি।’

হরিবালা দাস নামে এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী জানালেন, রাহেনা খাতুন নামে অপর একজনের বদলি ডিউটি করছেন তিনি। রাহেনা সিটি করপোরেশনের স্কেলভুক্ত কর্মী। তার মাসিক বেতন ২০ হাজার টাকার বেশি। কিন্তু হরিবালা দাস পান মাত্র ছয় হাজার টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাহেনা খাতুন করপোরেশনের স্টাফ হয়েও কাজ করেন না। হরিবালাকে দিয়ে তিনি নিজের কাজ করাচ্ছেন। এজন্য হরিবালাকে মাসে দেন ছয় হাজার টাকা। আর কাজ না করে ঘরে বসে ১৪ হাজার টাকা পাচ্ছেন রাহেনা খাতুন। কাগজে-কলমে চাকরিটি তার হলেও তিনি কখনও দায়িত্ব পালন করেন না।।

4তবে প্রাপ্তি নিয়ে বুকভরা ক্ষোভ আর অভিযোগ থাকলেও নগরবাসীর কল্যাণ চান হরিজন। তিনি বলেন, ‘মানুষ আমাদের ঘৃণা করলেও এই শহরটারে ভোরের আলোর মতো পরিষ্কার রাখি আমরাই। এটাই আমাদের প্রাপ্তি। আমরা চাই, আমাদের কষ্ট হলেও এই শহরটা পয়পরিষ্কার থাকুক। মানুষগুলো নিরাপদে থাকুক। রোগবালাই না ছড়াক।’

জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় নিয়মিত স্কেলভুক্ত এক হাজার ৭০০ এবং দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে ৫ হাজার ৩০০-সহ মোট ৮ হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী রয়েছেন। আর উত্তর সিটিতে নিয়মিত স্কেলভুক্ত ২ হাজার ৭০০ ও প্রাইভেট কোম্পানির এক হাজার ৩০০ কর্মী কাজ করছেন। সব মিলিয়ে দুই সিটিতে প্রায় ১২ হাজারের মতো পরিচ্ছন্নতাকর্মী রয়েছেন। এদের মধ্যে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কর্মীরা নিজ নিজ সংস্থার দেওয়া করোনা রোধকারী কিছু সুরক্ষা সরঞ্জাম পেলেও অন্যান্য কর্মী তা পাননি।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা অভিযোগ করেন, কোনও পরিচ্ছন্নতাকর্মী মারা গেলে তাদের পরিবারকে সিটি করপোরেশন থেকে আগে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হতো। কিন্তু এখন তাও ঠিকমতো দেওয়া হয় না। বিভিন্ন অজুহাতে তা আটকে রাখা হয়। পে-স্কেলভুক্ত যেসব কর্মী রয়েছেন তাদের নতুন পে-স্কেলও দেওয়া হচ্ছে না। আক্ষেপ করে তারা বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মচারীদের জন্য তো দুই নিয়ম হতে পারে না।

দুই সিটির স্ক্যাভেঞ্জার্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন সূত্র জানিয়েছে, গত ১২ বছরে দুই সিটি করপোরেশনের অন্তত এক হাজারের বেশি পরিচ্ছন্নতাকর্মী মারা গেছেন। এদের মধ্যে ২০১৩ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ হওয়ার আগে মারা যান ৬০০ জনের মতো। আর ভাগ হওয়ার পর দক্ষিণ সিটিতে মারা গেছেন দুই শতাধিক কর্মী। এ সময় উত্তর সিটিতেও মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় একই। এদের অধিকাংশই ক্যানসারসহ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। কর্মীদের দাবি, পরিচ্ছন্নতা কাজে এ ধরনের রোগের ঝুঁকি বেশি। তারা জানান, সিটি করপোরেশনের নিজস্ব স্টাফ হলেও বেতন ছাড়া তারা সরকারি অন্য কোনও সুযোগ-সুবিধা পান না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটির স্ক্যাভেঞ্জার্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কাজ করতে গিয়ে আমাদের অনেক কর্মী মারা গেছে।’ তিনি জানান, দুই সিটি ভাগ হওয়ার আগে ২০০৪ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত  ২৩ জন কর্মী মারা যান। ২০০৫ সালে ৬৪ জন, ২০০৬ সালে ৬৮ জন, ২০০৭ সালে ৭১ জন, ২০০৮ সালে ৫৯ জন, ২০০৯ সালে ৭২ জন, ২০১০ সালে ৬৯ জন, ২০১১ সালে ৬৫ জন, ২০১২ সালে ৬২ জন, ২০১৩ সালে ৫৩ জন, ২০১৪ সালে ৬০ জন, ২০১৫ সালে ৫৮ এবং ২০১৬ সাল ৭২ জন মারা গেছেন। এরপর এখন পর্যন্ত মারা গেছেন আরও শতাধিক কর্মী।

6

পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের এই নেতা বলেন, ‘আমরা যে কাজ করি, এটা সব মানুষ পারে না। ঝড়-বৃষ্টি, ঈদ, যেকোনও পার্বণ বলেন, সব সময় আমাদের কাজ করতে হয়। নগরীর সুনাম রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ সময়েও আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। আমরা অনেক সমস্যার সম্মুখীন হই। কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় সড়কে গাড়ি চাপা দিয়ে ফেলে রেখে যায়। অনেকেই মারা যান, আবার অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করেন। এ কাজে অনেক ঝুঁকি থাকে। কিন্তু আমরা ঝুঁকিভাতা পাই না।’ আব্দুল লতিফ আরও বলেন, ‘আগে মারা গেলে করপোরেশন থেকে মৃত ব্যক্তির পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হতো। এখন বিভিন্ন অজুহাতে তাও বন্ধ রাখা হয়েছে। উত্তর সিটির কোনও কর্মী মারা গেলে তার পরিবার দুই লাখ করে পায়। আমরা পাই না। এরপরও আমাদের কোনও সুনাম নেই। সবাই আমাদের নেগেটিভভাবে দেখে। ঘৃণা করে। ময়লা-আবর্জনায় কাজ করতে গিয়ে আমাদের অনেক কর্মী ক্যানসার, চর্মরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত। ঠিকমতো চিকিৎসা নিতে পারেন না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটির অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ছিদ্দিকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আসলে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা রাতদিন কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের কারণেই আমরা শহরটাকে পরিষ্কার রাখতে পারছি। তাদের অনেক দাবি রয়েছে। এরমধ্যে ঝুঁকিভাতা ও তাদের বিমার আওতায় আনা। বর্তমানে তাদের কোনও জীবন বিমা নেই। তবে ঝুঁকিভাতা দেওয়ার বিষয়ে আমরা একটি ফাইল মেয়রের দফতরে পাঠিয়েছি। সেটি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।’ তিনি বলেন,  ‘মৃত্যুর পর তাদের মেয়রের ঐচ্ছিক তহবিল থেকে একটা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া, আমরা ১৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য ১০ তলাবিশিষ্ট নতুন ১৩টি আবাসিক ভবন নির্মাণ করে দিয়েছি। এর মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মীর আবাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। তাদের বেতন-ভাতাও বাড়ানো হয়েছে।’

5উত্তর সিটির অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এস এম শফিকুর রহমান বলেন, ‘পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কাজ করেন বলেই আজ ঢাকা শহর এত সুন্দর। আমরা তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। করোনার মধ্যে কাজ করার জন্য হ্যান্ড গ্লাভস, বুট ও মাস্কসহ অন্যান্য সুরক্ষা সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে। কোনও কর্মী মারা গেলে তাদের এককালীন দুই লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান মেয়র তাদের জন্য ঝুঁকিভাতার ব্যবস্থা করেছেন। আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা দিচ্ছি। তাদের চাকরি যে ক্যাটাগরির তার সর্বোচ্চটাই দেওয়া হচ্ছে। চাকরির বেতন ছাড়াও যারা এক-দুই ঘণ্টা বেশি কাজ করেন, তারা আলাদা সম্মানী পাচ্ছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা স্বাস্থ্য বিমার আওতায় রয়েছে। পাশাপাশি তাদের জন্য হেল্থ কেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আনোয়ার খান মডেল হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের চুক্তি রয়েছে। কর্মীদের বিনামূল্যে ক্যানসার পরীক্ষা করা হচ্ছে। থাকার জন্য কোয়ার্টার করে দিচ্ছি। সেখানে বাচ্চাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আমাদের তদারকির কারণেই একজন কর্মীও করোনায় আক্রান্ত হননি।’