নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, নারীর জন্য অ্যাকাউন্টস, এইচআর, ডক্যুমেন্টেশনের মতো কয়েকটি সেক্টরে কাজের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে যেন তাদের সক্ষমতা নেই। কাজ না দিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্তে আসাটা ভীষণ আপত্তিকর।
বাংলাদেশের বাস্তবতা সবক্ষেত্রে নারীদের কাজের উপযোগী নয়–এই যুক্তি দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘ডেস্ক জবে আমরা নারীদের রাখি। বাইরের নিরাপত্তা দিতে পারবো না বলে এবং এ ধরনের পদে যোগ্য নারীর অভাবও রয়েছে। এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে যোগ্য পুরুষও পাওয়া যায় না।’
তারা বলছেন, বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে অন্য শহরে চলে গেলে প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সব মিলিয়ে এভাবে ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
সম্প্রতি সেলস অ্যান্ড মার্কেটিংয়ের সিনিয়র এক্সিকিউট, এক্সিকিউট, টেকনিক্যাল অপারেশনে সিনিয়র জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার, ফায়ার অ্যান্ড লাইফ সেফটি সিস্টেম সেলসের মার্কেটিংয়ের সিনিয়র এক্সিকিউট পদের জন্য চাকরির বিজ্ঞাপনে আবেদনের জন্য কেবল পুরুষদের আহ্বান জানানো হয়েছে।
নারী এসব কাজে আগ্রহ দেখায় না উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক রুবায়েত ফয়সাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নারীরা ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে এগিয়েছে এমনটাও কম। ফিল্ডের জবে তাদের আগ্রহও কম।’
চাকরি দিয়েছেন কিন্তু পারেনি এমন কোনও উদাহরণ তার কাছে আছে কিনা প্রশ্নে তিনি সুর পাল্টে বলেন, ‘নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারার কারণে ফিল্ডের কাজসহ অনেক ক্ষেত্রে আমরা নারীদের নিতে পারি না। আমাদের এখানে অ্যাকাউন্টস, অ্যাডমিন ডেস্ক জবে নারী আছে। আপনি নিজেও বিস্মিত হবেন এখনও মেয়েরা অভিভাবক সঙ্গে নিয়ে ইন্টারভিউ দিতে আসে।’
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় বিয়ে করে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় চলে যাওয়ায় চাকরি ছেড়ে দেয়, প্রতিষ্ঠানকে ভুগতে হয়। আর যে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে সেগুলো নারীদের জন্য ঠিক যথাযথ নয়।’
প্রকৌশলী নারী কম, আইটি সেক্টরে আরও কম, দিনরাত কাজ করানো যায় না, বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেলে প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয় এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মেট্রোরেল প্রজেক্ট, লাইন ওয়ানের সাইট ইঞ্জিনিয়ার কানিজ নাঈমা বলেন, ‘কোনও কোম্পানি বা অফিস যদি ধরেই নেয় যে নারী প্রকৌশলী হতে পারবে না। যদি যুক্তি হাজির করতে থাকেন তাহলে বুঝবেন সেফটি ইস্যুতে অবশ্যই ঝামেলা আছে। একটা অফিস যদি নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে পারে, তাহলে ওই অফিসের নারী প্রকৌশলীরা অবশ্যই সুন্দর আউটপুট দিতে পারবে, হোক সেটা বিয়ের পরেও।’
আইটি সেক্টরে ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস চলে, তবে অবশ্যই সেটা শিফটিং ডিউটি। একজন নারী প্রকৌশলী যদি সেফটি ইস্যুতে রাতে ডিউটি করতে না চান তাহলে সেক্ষেত্রে তাকে ডিউটি দেওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে পুরুষ প্রকৌশলীদের অবশ্যই নাইট শিফটে বাধ্যতামূলক ডিউটিতে থাকতে হয়। এখানেই মেইন সমস্যার তৈরি হয়। নারীকে এই ইস্যুতে দুর্বল ভাবা হয় এবং ক্যারিয়ার মেইন স্ট্রিমে পুরুষ এগিয়ে থাকে।
যারা নারীদের নিয়ে কাজ করবেন তাদের বিশেষ প্রণোদনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে দেশের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর সেবা খাতের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-এর সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জেন্ডার বৈষম্যবিরোধী অবস্থান থেকে কাজ করি আমরা। তাদের এই জবে বিশেষ রিকোয়ারমেন্ট আছে কিনা দেখতে হবে। আমরা নারীদের আইটি সেক্টরে এগিয়ে নিতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছি। ঘরে বসে আয়ের ব্যবস্থা নিয়েও কাজ করছি। যাই বলি না কেন, বাস্তবতা হলো, সন্তান লালনসহ বেশকিছু পারিবারিক দায়িত্ব তাকে পালন করতে হয়।’
প্রতিষ্ঠানগুলো যে বাস্তবতার কথা বলছে তা কিন্তু সত্যি উল্লেখ করে ব্র্যাকের জেন্ডার কর্মসূচির পরিচালক নবনীতা চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ কারণেই কর্মক্ষেত্রে ও গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা, শিশু যত্ন, সংসারের কাজে নারী পুরুষের সমান অংশগ্রহণ এই প্রত্যেকটি বিষয় আসলে নারীর সমানাধিকারের সঙ্গে যুক্ত। নইলে কোনও প্রতিষ্ঠান লিখে দেবে চাকরিটি তারা পুরুষকেই দিতে চায় আর কোনও প্রতিষ্ঠান হয়তো লিখবে না কিন্তু পুরুষকেই দেবে। আর বাংলাদেশে শ্রমশক্তির ৯০ শতাংশের বেশি নারী চাকরির আয় উন্নতি সুযোগ সুবিধার বাইরে অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে যেতে থাকবেন।’
এসডিজি এসব সূচকে উন্নয়ন দেখে নারীর অবস্থা বিবেচনা করার কথা বলে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রকে ঘর থেকে সব পরিসরে নারীর নিরাপত্তা, শিশু যত্ন কেন্দ্র এগুলোর যেমন ব্যবস্থা করতে হবে তেমনি কোনও প্রতিষ্ঠান অন্যায়ভাবে নারীর মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া এড়িয়ে যেতে বা শিশু যত্ন কেন্দ্র এবং নারী কর্মীর নিরাপদ কর্মক্ষেত্র তৈরির ক্ষেত্রে তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে শুধু পুরুষ কর্মী নিয়ে কাজ চালাতে চাইছে কিনা সেই জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করতে হবে। নারীর নিরাপত্তা এবং শিশু যত্ন কেন্দ্র নিশ্চিত করার মতো বাধাগুলো দূর করতে না পারাতেই আমরা দেখি গত ১০ বছরে নারীর কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ প্রায় কিছুমাত্র বাড়েনি।’