করোনায় সেবা দেওয়া চিকিৎসকরা কেউ হাসপাতালে, কেউ হোটেলে

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে কাজ করা চিকিৎসকসহ অন্যরা

‘নিজের জন্য না, খারাপ লাগাটা আসলে মা-বাবার জন্য। তারা ভাবেননি যে, ছেলে একা একা এভাবে হোটেলে ঈদ করবে, আর  তারা সবাই বাসায় থাকবেন। মা-বাবা দুজনেই বারবার করে ফোন করে জানতে চেয়েছেন— কী করছি, কী খাচ্ছি। আসলে আমরা যে বড় হয়েছি, বাস্তবতা বুঝতে শিখেছি, বাবা-মায়েরাও সেটা বোঝেন। মন কি সবকিছু বোঝে? বোঝে না’, বলছিলেন ডা. আলিম আল  রাজি।

করোনা মহামারির দুর্যোগের কারণে চিকিৎসাসেবার সঙ্গে জড়িত চিকিৎসক, নার্স,স্বাস্থ্যকর্মীসহ সবার ছুটি বাতিল করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ঈদের ছুটিসহ, সাপ্তাহিক ছুটি এবং যেকোনও বন্ধের দিনে  রোগীর নমুনা সংগ্রহ, নমুনা পরীক্ষা-সহ কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য নির্দেশনা দেয় মন্ত্রণালয়।

হাসপাতালগুলোতেও চিকিৎসকদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। সাধারণ সময়ে মুসলিম চিকিৎসকরা দুই ঈদে ছুটি কাটান, অন্য ধর্মালম্বীরা দায়িত্ব পালন করেন। তবে ডেঙ্গুসহ বর্তমানে করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে গত ঈদেও সেটা সম্ভব হয়নি। সমানতালে সব ধর্মের চিকিৎসক, নার্সসহ  স্বাস্থ্যকর্মীরা চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত রয়েছেন।

হাসপাতালে করোনা রোগীর সেবায় তারা দায়িত্ব পালন করছেন। আবার চিকিৎসকদের আরেকটি গ্রুপ অবস্থান করছেন হোটেলে। নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালে ডিউটি করার পর হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে এবং কোয়ারেন্টিন শেষ হলে পরে তারা বাসায় ফিরে যাবেন।

সিলেটের একমাত্র সরকারি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল সিলেট শহীদ শামসুদ্দীন আহমেদ হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেছেন ডা. আলিম। হাসপাতালে গত ২০ জুলাই থেকে ডিউটি করেছেন। তারপর নিয়ম অনুযায়ী  সিলেটের একটি হোটেলে  গত ৩০ জুলাই থেকে কোয়ারেন্টিনে আছেন। হোটেল কক্ষেই কাটছে তার এবারের ঈদ।

ডা. আলিম বলেন, ‘আইনজীবী বাবা মনজুর কাদির ঈদের আগের দিন থেকেই ফোন করে কান্নাকাটি করছেন। বাবা ঈদের দিন হোটেলেও এসেছিলেন, আমিও নিচে গিয়েছিলাম তাকে দেখতে। কাছাকাছি হতেই তিনি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরতে চাইলেন। কিন্তু একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি তো জানি— আমাকে ছোঁয়া বা স্পর্শ করা যাবে না। তাই কোনো রকমে দূরে থেকেই বাবাকে বিদায় দিয়েছি।’ 

ডা. আলিম জানান, বাবাকে বিদায় দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু আমাকে ছুঁতে না পারার কারণে তার মনটা যে আদ্র হয়ে আছে, সেটা বোঝা গেলো তার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতে গিয়ে।

‘‘আমার বাবা একটু বেশি আবেগি— বলতে বলতেই ধরে এলো ‘কঠিন হৃদয়ের’ এই চিকিৎসকের গলা। বললেন, ‘টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার নিয়ে বাবা আমাকে দেখতে এসেছেন। অথচ দূর থেকে তাকে বিদায় দিয়ে রুমে ফিরে এলাম… বুকের ভেতরটা কাঁপছে, আর  আমি কাঁদছি।’’

সিলেট শামসুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা কাজ করছেনএকই হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে দায়িত্বরত আরেক চিকিৎসক ডা. তাহমিনা ইয়াছমিন চৌধুরী। সিলেটেই বাড়ি, হাসপাতালের খুব কাছেই। কিন্তু ঈদের দিনটা কেটেছে হোটেল কক্ষে। ‘সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত মা কতবার ফোন করেছেন, আঙ্গুল গুণে বলতে হবে’,বলেন তাহমিনা।

ডা. তাহমিনা জানান, প্রথমে আইসিইউ পরে করোনা ওয়ার্ডে কাজ করেছেন তিনি গত ২২ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। বাসা কাছে হওয়ার পরও সেখানে যেতে পারছেন না মা অসুস্থ বলে। কোয়ারেন্টিন শেষ না করে বাসায় যাওয়া যাবে না। বাসার অন্যদের জন্য সেটা হুমকি হয়ে যাবে— যতক্ষণ না আমরা নিজেরা নেগেটিভ না আসছি। আজকের সকালটা এত বিষণ্ন ছিল, জীবনে প্রথম পরিবারকে ছাড়া ঈদ করলাম। কয়েক কদম এগুলেই বাসায় যেতে পারি, কিন্তু পারছি না। এর আগে হাসপাতালে ডিউটি করেছি, সেটা একরকম ছিল, কাজ শেষে বাসায় ফিরেছি। কিন্তু কাজ শেষে এরকম ‘ডিটাচ’ এই প্রথম।…এই খারাপ লাগাটা… কিন্তু কিছুই করার নাই। ডা. তাহমিনা বলেন, ‘রোগীদের সেবা করাটাও আমাদের ধর্ম। মানুষের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। তবে একটাই আশায় রয়েছি— করোনা শেষে সবাই যদি সুস্থ থাকে, তাহলে আবারও পরিবারের সঙ্গে ঈদ করবো।’

ডা. নাকিব শাহ আলমরাজধানীর বেসরকারি এভারকেয়ার (সাবেক অ্যাপোলো) হাসপাতালের কার্ডিয়াক অ্যানেস্থেশিয়া অ্যান্ড আইসিইউ স্পেশালিস্ট রেজিস্ট্রার ডা. নাকিব শাহ আলম। প্রতিবছরই একটা ঈদ হাসপাতালে কাটাতে হয় তার। এবার রোগীর সংখ্যা কম। তারপরও  তাকে হাসপাতালেই কাটাতে হচ্ছে। ‘এটাই যে নিয়ম, তা জেনে শুরু থেকেই চিকিৎসকরা সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেন। আমরাও তার ব্যতিক্রম নই’, বলেন ডা. নাকিব।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. রাজীব দে সরকার বলেন,  ‘সার্জারি বিভাগ থেকে ভাগ হয়ে করোনা ইউনিটে কাজ করার পর আবারও কোয়ারেন্টিন করছি আমরা। কারণ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালতো একইসঙ্গে কোভিড এবং নন কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘ঈদের ছুটি কখনও ছিল না।’ চিকিৎসক হওয়ার পর থেকে কখনও ঈদে ছুটি কাটাইনি মন্তব্য করে ডা. রাজীব বলেন, ‘এটা নিয়ে দুঃখ নেই। এটা রুটিন হয়ে গেছে আমাদের।’

ঈদের দিনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসকরারাজধানীর করোনা ডেডিকেটেড কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ঈদের দিনে আইসিইউতে ডিউটি করেছেন ডা. ফাল্গুনি বসাক মিতু। তিনি বলেন, ‘মেডিক্যাল অফিসার দুই জন, কনসালটেন্ট তিন জন। এছাড়া আইসিইউ ইনচার্জ ডা. শাহজাদ হোসেন মাসুম স্যার সকালে এসে সারাদিন ছিলেন। তাই খারাপ লাগেনি। আর এটাতো একটা দুর্যোগের সময়, মনকে সেভাবেই মানিয়ে নিয়েছি।’

ডা. ফাল্গুনি বলেন, ‘ শনিবার (১ আগস্ট) সকাল আটটায় ডিউটিতে এসেছি। রবিবার সকালে পরবর্তী দলের কাছে দায়িত্ব হ্যান্ডওভার করে বাসায় যাবো।’ একটানা তিন দিনের ডিউটি করে বাসায় আইসোলেশনে থাকবেন তিনি  বলে জানান তিনি। 

শামসুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্বররত চিকিৎসকরাবিভিন্ন দুর্যোগসহ প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুম। অধিদফতরের এই কন্ট্রোল রুমটি গণমাধ্যমের নজর কেড়েছে গত বছর ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের সময়। প্রতিদিনের ডেঙ্গুরোগীর পরিসংখ্যানসহ নানা আপডেট দিয়ে তারা গণমাধ্যমসহ জনসাধারণকে সহায়তা করেছে। চলতি বছরে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনা মহামারি এবং অতি সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে বন্যা।

কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক এবং বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ডা. আয়েশা আক্তার শনিবার ঈদের দিনেও ডিউটি করেছেন। তার সঙ্গে কথা হয় এদিন বিকালে। তিনি জানান, মাত্র অফিস থেকে বাসায় ফিরেছেন। ঈদের দিন অফিসে কাজ করার বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, ‘পরিবারের জন্য কষ্টকর, আমার জন্য নয়। তবে সকালে যখন বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম, তখন আমার ছেলে বলেছিল— আজও  অফিস,  ঈদের সময়েও যাচ্ছো।’

ডা. আয়েশা আক্তার জানান, কন্ট্রোল রুমে ঈদের দিনে মোট আটজ ন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করছেন সকাল থেকে।