বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ইয়াবা পাচারের সময় বিমানবন্দরে একাধিকবার ধরা পড়ে পাচারকারী চক্রের সদস্যরা। একইসঙ্গে বাংলাদেশ থেকে পার হয়ে গেলেও বিদেশে ধরা পড়েছে সেসব ইয়াবা। এ কারণে সরাসরি ইয়াবা পাচার না করে এখন ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল পাচারের কৌশল নিয়েছে পাচারকারী চক্র।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মেটাফিটামিন, অ্যামফিটামিন ও সিউডোফিড্রিন ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। এই রাসায়নিক সাদা পাউডার অতিরিক্ত মাত্রায় উত্তেজক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসব উপাদান ব্যবহার করে সহজেই ইয়াবা তৈরি করা যায়। এক কেজি সিউডোফিড্রিন দিয়ে ২ লাখ পিস ইয়াবা তৈরি করা যাবে। কাঁচামাল থাকলে ঘরে বসেই ইয়াবা তৈরি করা যায়, এটা খুব কঠিন কাজ নয়।’
বুধবার ১৫ কেজি ৬৫৮ গ্রাম ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল এমফিটামিন ধরা পড়ার পর সংবাদ সম্মেলন করে শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। এই বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ উল-আহসান বলেন, ‘৯ সেপ্টেম্বর রাত ২টার দিকে রফতানি কার্গো ভিলেজে ডুয়েল ভিউ স্ক্যানার মেশিনে তল্লাশির সময় মাদক শনাক্ত ও আটক করা হয়। আমার গত ১১ মাসের অভিজ্ঞতায় এ ধরনের মাদকের কাঁচামাল রফতানি পণ্যের সঙ্গে আগে ধরা পড়েনি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ অন্যান্য সংস্থাও বলছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি প্রথম বড় চালান।’
সেখানে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরীক্ষক শফিকুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘এমফিটামিন বাংলাদেশে এই প্রথম। এর আগে এত বড় চালান ধরা পড়েনি।’
তবে তাদের এই দাবি সঠিক নয়। এর আগেও একই ধরনের মাদক পাচার হলেও ধরতে পারেননি বিমানবন্দরের এভিয়েশন সিকিউরিটির সদস্যরা। গত বছরের ১০ নভেম্বর ঢাকা থেকে যাওয়া একটি ফ্লাইটে ১০টি কার্টনে থাকা ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল ‘সিউডোফিড্রিন’ ধরা পড়ে মালয়েশিয়ায়। কাস্টম নারকোটিকস মালয়েশিয়ার দেওয়া তথ্য ও অভিযোগের ভিত্তিতে এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা হয়েছে।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে (এমইচ-১৯৭) হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কার্গো মিডিয়া এজেন্সি লিমিটেডের একটি শিপমেন্ট ওঠানো হয় (শিপমেন্ট নম্বর MAWB 232-4136850)। সেই শিপমেন্টের ২৭টি কার্টন ঢাকা থেকে মালয়েশিয়া হয়ে সিডনিতে পাঠানোর জন্য ফ্লাইটে তোলা হয়। পরবর্তীতে ১০ নভেম্বর কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে সেই কার্টনগুলো পুনরায় কাস্টম নারকোটিকস মালয়েশিয়া রি-স্ক্যান করে। ২৭টি কার্টনের মধ্যে ১০টির গায়ে কোনও সিকিউরিটি চেকড সিল বা স্টিকার ছিল না। এসব কার্টনের ভেতরে অ্যালুমিনিয়ামের ফয়েল প্যাকেট পাওয়া যায়। প্যাকেটগুলোর ভেতরে ছিল সিউডোফিড্রিন (Pseudoephedrine-PSE)।
সূত্র জানায়, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে প্রথমে ২৭টি কার্টন আনা হয় এবং সিকিউরিটি চেক শেষে সিকিউরিটি স্টিকার ও সিল দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আরও ১০টি কার্টন আনা হয়, যেগুলোর ভেতরে সিউডোফিড্রিন ছিল। সুযোগ বুঝে সিকিউরিটি চেক হওয়া ১০টি কার্টন সরিয়ে সিউডোফিড্রিন থাকা ১০টি কার্টন শিপমেন্টে দিয়ে দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ঘাটতি দেখিয়ে ২০১৬ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশের সঙ্গে আকাশপথে সরাসরি কার্গো পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাজ্য। পরবর্তীতে দেশটির পরামর্শে নিরাপত্তা পরামর্শক, প্রশিক্ষণের জন্য ২০১৬ সালের ২১ মার্চ যুক্তরাজ্যের রেডলাইন অ্যাসিউরড সিকিউরিটির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। রেডলাইন বিমানবন্দরের এভিয়েশন সিকিউরিটি কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়। পাশাপাশি বিমানবন্দরে যাত্রীদের ব্যাগ, কার্গো তল্লাশির জন্য বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়। প্রায় দুই বছর পর ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের করে যুক্তরাজ্য।
বিমানবন্দরের একাধিক সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, রফতানি কার্গো ভিলেজে এককভাবে কাজ করেন এভিয়েশন সিকিউরিটির সদস্যরা। সেখানে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ও কাস্টম হাউজের কোনও প্রতিনিধি নেই। ফলে সেখানকার কর্মীরা অপরাধে জড়িয়ে পড়লে দেখার কেউ নেই। নিরাপত্তা তল্লাশি যথাযথভাবে হলে এসব মাদক মালয়েশিয়া পর্যন্ত যেতে পারতো না। সবচেয়ে বড় কথা, রফতানি কার্গো ভিলেজের ভেতরেই শিপমেন্টের ২৭টি কার্টন থেকে ১০টি কার্টন সরিয়ে মাদকের ১০টি কার্টন বদলানো হলো কীভাবে। যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন, তারা যদি সহায়তা না করেন তাহলে তো এ ঘটনা ঘটার কথা না।
এ প্রসঙ্গে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার উপ-পরিদর্শক মো. মাহবুব হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মামলাটির তদন্তকাজ এখনও শেষ হয়নি। পাচারের এ ঘটনায় আরও কারা জড়িত এই মুহূর্তে সেটি বলা সম্ভব হচ্ছে না। দ্রুত তদন্ত শেষ হলে মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে।’