‘ট্রল’ কি খারাপ?

ট্রল
এইতো কিছুদিন আগে, অভিনেত্রী পরীমনি তার জন্মদিনের পোশাকের রঙ নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘ময়ূর’ এর ইংরেজি শব্দ ‘পিকক’ বলতে গিয়ে ‘ককপিট’ বলে ফেলেন। তাৎক্ষণিক তিনি আবার শুদ্ধ উচ্চারণটাই করেন। তবে ওই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। তার ইংরেজি জানা বা না-জানা নিয়ে ‘ট্রল’ করতে থাকেন অনেকেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের একটি প্ল্যাটফর্ম ‘উই’ তে যখন কেউ নিজের পরিচয় দেন, তখন আমি ‘অমুক’,কাজ করছি ‘অমুক বিষয়ে’ লেখেন। সেটি নিয়ে চলতে থাকে ট্রল। ফেসবুকে ব্যাংকার, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশা-শ্রেণির প্রতিনিধিদের এ ধরনের ট্রলে অংশ নিতে দেখা গেছে। এ ট্রলটি মূলত শুরু হয় ফেসবুকভিত্তিক নারী উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফর্ম উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)-কে হেয় করতেই।

২০২০ সালের অক্টোবরের হিসাব মতে, বাংলাদেশে ১১ কোটি ৭ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে বড় অংশ নারী। কিন্তু তাদের সাবলীলভাবে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে ছবি, ভিডিও, কমেন্ট যেকোনও  ট্রল হওয়ার শঙ্কায়। ইতোমধ্যে নানা সময়ে ট্রলের শিকার হয়েছেন যারা, তারা বলছেন, ট্রল বিষয়টি আদতে খারাপ না, কিন্তু  ট্রলের নামে আমাদের দেশে, এমনকি এই উপমহাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা করা হয়— তা হেট স্পিচ, স্পষ্টতই হয়রানি। এই হয়রানি অবশ্যই অপরাধ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ ধরনের হয়রানির শিকার হলে, ব্যবস্থা নিতে দ্রুত থানায় যোগাযোগ করতে হবে। বাকি ব্যবস্থা তাদেরকে সেখানে জানিয়ে দেওয়া হবে। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার অনেক উদাহরণ ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে।

সাধারণত ট্রল শব্দটা দিয়ে ছবি বা কার্টুন ব্যবহার করে কোনও একটি বিষয়ে স্যাটায়ার ও সমালোচনা করা বুঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে ট্রল করতে গিয়ে ছবি এডিট করে বা অনলাইনের কমেন্ট এডিট করে মানহানিকর উপস্থাপনার মাধ্যমে হয়রানি করা হয়। ট্রলের শিকার একাধিক ব্যক্তি বলছেন, নিজেদের ছবি দেওয়ার কারণেও অশ্লীল এবং মানহানিকর মন্তব্যের শিকার হতে হয়েছেন কোনও কোনও সময়। তারা বলছেন, সাবলীলভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করবো সেটাও পারি না।

গণমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি এবং একবারে শুরুর সময় থেকে ট্রল করা হয় সাংবাদিক মুন্নী সাহাকে। ট্রলকারীদের দাবি, টেলিভিশনের সাংবাদিক হিসেবে তিনি ভীষণ মুমূর্ষু রোগীকেও  ‘আপনার অনুভূতি কী?’ জিজ্ঞেস করে থাকেন। এর কোনও সত্যতা যদিও দেখাতে পারেননি কেউ। ট্রল হলে কী ধরনের মানসিক চাপ হয় এবং কেউ সেই চাপ সামলাতে কী করবেন প্রশ্নে মুন্নী সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ট্রল শব্দটার পেছনে এক ধরনের বুদ্ধিদীপ্ত  মজা আছে। কোনও  কোনও পরিচিত মুখকে ব্যবহার করে, সেই মজা বা মজার ছলে একটা প্রতিবাদ সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বিনোদনটির নাম ট্রল, আমার কাছে। কিন্তু আপনি যেটাকে ইঙ্গিত করে প্রশ্নগুলো করেছেন, সেগুলো ট্রল— হেট স্পিচ। পরিষ্কার হয়রানি। দিব্যি এসব চলছে,বিশেষ করে মেয়েদের বেলায়।’ 

মুন্নী সাহা বলেন, ‘আপনি আমাকে এ ব্যাপারে যে কারণে প্রশ্ন করেছেন, সেটা যে কোনও পাঠকমাত্রই বুঝবেন, যদি বাংলাদেশের হেট স্পিচের কন্টেন্টগুলো গোনা যেতো। তাহলে বুঝতে পারতেন কত বিপুল পরিমাণ হেট স্পিচ-এর শীর্ষে আমি অবস্থান করছি। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের তারানা (তারানা হালিম) আপা, তখন তিনি প্রতিমন্ত্রী, আমাকে ফোন করে জানতে চেয়েছেন— কীভাবে ভার্চ্যুয়াল জগতের এসব নোংরা, মিথ্যা, হেট কন্টেন্ট দেখে আমি সহ্য করি বা ব্যবস্থা নিই? অনেক এমপি ও সেলিব্রেটি একই কথা জানতে চান, রোজই।’

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, আমাকে নিয়ে এসব নোংরা আজেবাজে জিনিস ছড়ানো, বা গালি দিতে হলেও তো ২/৪ মিনিট সময় ব্যয় করতে হয়। একটি দেশে আমাদের বাংলাদেশ এম্বেসির একজন ঊর্ধ্বতন মহিলা অফিসার, তার বন্ধুর ওয়ালে আমাকে নিয়ে একটা মন্তব্য করেছেন। একটু ঘেঁটে দেখলাম, উনি নির্বাচন, গণতন্ত্র এবং  প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে দিব্যি নেগেটিভ মিথ্যাচার ছড়িয়ে যাচ্ছেন। যারা এসবের ব্যবস্থা নেন, তারা সেটা জানেনও! ফলে, আমাদের মতো, ঘামের গন্ধের মানুষের জন্য কাজ করা টেলিভিশন কর্মীর কি কোনও কিছুর জন্য নালিশ করা মানায়? আমি সো কল্ড ট্রলকারীদের, হেটারদের মঙ্গল কামনা করি।’

ফেসবুকে কমবেশি অর্ধশত বার ট্রলের শিকার হয়েছেন লেখক ও সাংবাদিক অঞ্জন রায়। গভীর ডিপ্রেশন থেকে ফেসবুকে লেখালেখিও প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যে লেখা বা কাজের দায় আমার, সেটার সমালোচনা করে, ট্রল করে ভাইরাল করা হলে সহনীয়। কিন্তু যে কাজের দায় আমার নয়, সেটা আমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে, আমার সন্তানদের ছবি দিয়ে, জেন্ডার অসংবেদনশীল ট্রল বা সাম্প্রদায়িক পোস্ট দিয়ে বুলিইং ভীষণ মানসিক পীড়াদায়ক। যারা এসব করেন, তারা যদি নিজেদেরকে আমার আসনে বসান, তাহলেই বুঝতে পারবেন তারা কী করছেন। আমার প্রায় দেড়লাখ ফলোয়ারের ভেরিফাইড অ্যাকাউন্ট হওয়ার পরেও এখন আমি কিছু লিখছি না। গত কয়েক মাস আমাকে ভয়ানক ডিপ্রেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।’ যারা আক্রমণ করে খুশি হতে চান, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হলে অনলাইন পরিস্থিতি সহনীয় হয়ে উঠবে বলে তিনি মনে করেন।

আমাদের অর্থনীতি পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাসুদা ভাট্টি বলেন, ‘যারা ট্রলের শিকার তাদের মানসিক চাপ বিশ্লেষণের আগে যারা এসব ট্রল করে, তাদের মানসিক বিকার নিয়ে কথা বলা জরুরি। তারা যে ভয়ঙ্কর ও কুৎসিত মনোবিকারে ভুগছেন সেটা এই সমাজের জন্য কতটা ভয়ের, সেটা বিবেচনায় আনলে আমরা বলতে পারি যে, ট্রলের শিকার হিসেবে তারা টার্গেট করে মূলত নারীকে। গ্রামের সাধারণ স্কুলে পড়া কিশোরীটি যেমন তাদের নোংরা ট্রলের শিকার হয়, তেমনই শিকার হন দেশের বরেণ্য সংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সাংবাদিক মুন্নী  সাহা কিংবা মাসুদা ভাট্টিও। ভয়টা সেখানেই যে, শেষোক্তরা যে প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এসব ট্রল মোকাবিলায় মানসিক শক্তি ও সামর্থ্য অর্জন করেছেন, তা ওই গ্রামের কিশোরীটির পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ, তাকে সমাজে টিকে থাকতে হলে এসব ট্রল, প্রচারণা এবং আঘাত সয়েই টিকে থাকতে হবে।’ মাসুদা ভাট্টি বলেন,‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবার থেকে মেয়েটি সহযোগিতা পায় না। ফলে তার পড়ালেখার ইতি ঘটে এবং তাকে হয় বিয়ে দেওয়া হয় কিশোরীকালেই, নয়তো তাকে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আমার মনে হয়, রাষ্ট্রকে এখানে হস্তক্ষেপ করতেই হবে, অন্তর্জালে চলা এইসব কুৎসিত আক্রমণ এবং ট্রলের শিকারদের পাশে দাঁড়িয়ে সেটা বন্ধ করার ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ দু’টোই করতে হবে। না করলে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী মূলত যারা নারী, তারা এর শিকার হতেই থাকবেন।’ 

তিনি বলেন, ‘একটি লেখা প্রকাশিত হলে তার নিচে মন্তব্যের ঘরে লেখার বিষয়ে আলোচনার চেয়ে নারী লেখককে যেভাবে হেনস্থা করা হয়, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে, কেন একজন লেখক এই জঘন্য ও নোংরা গালাগাল হজম করবেন? ফলে লেখক নিজেকে সড়িয়ে নিতে বাধ্য হন। কাউকে ব্যক্তি আক্রমণ কিংবা নোংরা গালি দেওয়া যে বাক স্বাধীনতা নয়, এটা যত দিন না বুঝবো, তত দিন আমাদের বাক স্বাধীনতা খর্ব হতেই থাকবে— এই অজুহাতে রাষ্ট্র আরও কঠোর হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পুলিশের পক্ষ থেকে নারীর জন্য আলাদা সেল গঠন করা হয়েছে, এটা আশাব্যঞ্জক। তবে আগে যেমনটা বলেছি, আইনের প্রয়োগ দরকার এবং এসব ট্রলকারীদের ক্ষেত্রে সেটা যতটা কঠোর হবে, ততটাই মঙ্গলজনক।’

সতর্ক থাকলে ট্রল এড়ানো যায় বলে মনে করেন ডা. আব্দুর নূর তুষার। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এমন আমার হয় না। কারণ,আমি আমার বক্তব্য সঠিকভাবে দেই। ভুল কথা বলি না। তবে অনেকেই মানসিকভাবে কষ্ট পান, ভেঙে পড়েন।’ ট্রল করাকে সাইবার বুলিইং হিসেবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘যারা ঘৃণা ছড়ায় এরা নিজেরা অসুস্থ। চিকিৎসা করানো উচিত তাদের।’

কেউ হেট স্পিচ বা তথাকথিত ট্রলের শিকার হলে কী ব্যবস্থা নেবে প্রশ্নে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রথমে অবশ্যই থানায় গিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করতে হবে। এরপর সেই জিডির কপি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সিটিটিসি’র ফেসবুক, অথবা পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের ফেসবুকের ইনবক্স, বা সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে দিয়ে বিষয়টি অবহিত করতে হবে। এমনকি এই পেজগুলোর যেকোনোটিতে সরাসরি অভিযোগ করার সুযোগও আছে।’