সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর অধিকাংশ স্থানেই নির্দিষ্ট যাত্রীছাউনি তো দূরের কথা, ফুটপাত ঘেঁষে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো হচ্ছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সড়কের মাঝ পথ থেকে যাত্রীদের ওঠানামা করানো হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী, নির্ধারিত স্থান বা স্টপেজ ছাড়ার পর বাসের দরজা বন্ধ রাখতে হবে। আবার অন্য স্টপেজে পৌঁছালে দরজা খুলতে হবে। কিন্তু এসবের কিছুই মানছে না পরিবহনগুলো। ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনা।
মঙ্গলবার (২২ ডিসেম্বর) সকালে নগরীর ব্যস্ততম সড়ক বাংলামোটরে দেখা গেছে, পান্থকুঞ্জ পার্কের বাংলামোটর মোড় সংলগ্ন কোনায় যে যাত্রী ছাউনিসহ বাস স্টপেজ চিহ্নিত করা আছে, সেখানে কোনও বাস দাঁড়াচ্ছে না। অপরদিকে বাংলামোটর মোড় ও সড়কের মাঝপথ থেকেই যাত্রী তোলা হচ্ছে। একই চিত্র মালিবাগ-রামপুরা সড়কের। এই সড়কেও দৌড়ে গিয়ে সড়কের মাঝখানে যাত্রীদের চলন্ত গাড়িতে উঠতে দেখা গেছে। পুরুষ যাত্রীদের পাশাপাশি নারীরাও রয়েছেন বাসে ওঠার এমন প্রতিযোগিতায়! পথচারীদের অনেকেই জানিয়েছেন, এখন প্রতিদিনই সড়কে এমন চিত্র চোখে পড়ে।
গত বছর বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) পরিচালিত এক জরিপের তথ্য বলছে, সারা দেশের শহরগুলোতে যে দুর্ঘটনা ঘটে, তার ৭৪ শতাংশই ঘটে রাজধানী ঢাকায়। অধিকাংশ দুর্ঘটনা বাসের কারণেই হচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এআরআই’র গবেষণা তথ্য বলছে, বাস চালকদের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণেই ঢাকায় বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। ঢাকায় সাম্প্রতিক আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর সবকটিতেই বাসের বেপরোয়া চালনাকে দায়ী করেছে এআরআই।
এআরআইয়ের তথ্যমতে, ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে ৬৬৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৬৯৯ জন নিহত এবং এক হাজার ২২৭ জন আহত হয়েছেস। এর মধ্যে ৩৫৪টি দুর্ঘটনাই ঘটেছে বাসের বেপরোয়া গতির কারণে। এছাড়া ওই সময়ে ১৩০টি মোটরসাইকেল, ১১৩টি ট্রাক, ৭৩টি পিকআপ এবং ৫৬টি ব্যক্তিগত গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটেছে।
অপরদিকে, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব মতে, চলতি বছরের মে মাস থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় ১০২টি দুর্ঘটনায় ১২০ জনের প্রাণহাণি ঘটেছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে সংগঠনটি বলছে, যত্রতত্র সড়ক পারাপার, নির্ধারিত স্থান থেকে যাত্রী ওঠানামা না করা, যাত্রীদের সড়ক মোড়েই নামার অভ্যাস, যানবাহন চলাচলে লেন না মানা এবং পরিবহন চালকদের নিয়মনীতি না মানা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
তিনি আরও বলেন, ‘সিমটম বা উপসর্গ-ভিত্তিক কোনও সমস্যার সমাধান হয় না, যদি সেখানে বিজ্ঞানসম্মত কোনও নির্দেশিত পথ না থাকে। আমরা যেকোনও সমস্যার সমাধান করতে চাই উপসর্গ দিয়ে। যে কারণে পুলিশের আইজিপি থেকে শুরু করে পরিবহন মালিকদেরও কোনও নির্দেশনা কাজে আসছে না। সড়কে দুর্ঘটনার উপসর্গ দেখে হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু কাজে আসেনি। কোনও জিনিসই কাজ করবে না, যদি আমরা সিমটমের দিকে তাকিয়ে থাকি। এজন্য প্রয়োজন একটি মডেল করিডোর। একটি করিডোরে একজন মালিকের বাস চললে সেখানে কোনও পুলিশ লাগবে না।এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘তারা মৌসুমি কাজ করে মৌসুমি সমাধান করতে চায়। এভাবে শৃঙ্খলা ফেরাতে গিয়ে যারা ফেল করেছে, তাদের লজ্জা পেয়ে চলে যাওয়া উচিত। সড়কের এমন বিশৃঙ্খলায় যারা বেনিফিশিয়ারি তাদেরকে সরিয়ে যদি বিজ্ঞানভিত্তিক টেকসই সমাধান গ্রহণ করা হয়, তাহলেই শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।’
অনেকে মনে করেন, দুর্ঘটনার দায় এড়ানো সহজ বলেই সড়কে এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। এই দুর্ঘটনার জন্য যেমন চালকদের দায় রয়েছে, ঠিক একইভাবে যাত্রী বা পথচারীদেরও দায় রয়েছে। কোনও পক্ষই এককভাবে দায় এড়াতে পারে না।
শিখর পরিবহনের চালক আলাউদ্দিন বলেন, ‘সব দায় কেবল আমাদের! যাত্রী যদি নির্ধারিত স্থানে না নামে, বা নির্ধারিত স্থান থেকে না ওঠে, তাহলে আমরা তো তাদের জোর করে নামাতে বা ওঠাতে পারি না। মানুষ বাস থেকে নেমে একটু হাঁটতে চায় না। তারা যদি একটু হাঁটার অভ্যাস করে, তাহলে আমরা যাত্রীদের নির্ধারিত স্থানেই নামিয়ে দিতে পারি।’
জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য পরিবহনের চালক, মালিক ও হেলপারদের অনেক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এটার জন্য আসলে শুধু একপক্ষকে দায়ী করা যায় না। এর পরেও আমরা দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে এনেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুর্ঘটনা কমানোর জন্য বাস ফ্র্যাঞ্চাইজি চালু করা হচ্ছে। আগামী বছরের পহেলা এপ্রিল থেকে ঘাটারচর-মতিঝিল রুটে পাইলট আকারে ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবস্থাপনা চালু করা হবে। তখন হাতিরঝিলের মতোই পরিবহন ব্যবস্থা চলবে।’