গোল্ডেন মনির ও তার সহযোগীদের বাঁচাতে পুলিশ কর্মকর্তার তদবির

আলোচিত সেই গোল্ডেন মনির ও তার সহযোগীদের বাঁচাতে এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদবিরের অভিযোগ উঠেছে। গোল্ডেন মনির ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে অনুসন্ধান করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি। সম্প্রতি গোল্ডেন মনিরের ৭ সহযোগীকে সিআইডি কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর থেকে ওই পুলিশ কর্মকর্তা প্রায়ই সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে তদবির করছেন। গোল্ডেন মনিরের সহযোগীদের মধ্যে একজন ওই পুলিশ কর্মকর্তার স্বামী। তার নাম হায়দার আলী। আরেকজন তার স্বামীর বড় ভাই। রিয়াজ উদ্দিন নামে ওই ব্যক্তি সিরাজগঞ্জের একটি উপজেলার চেয়ারম্যান। কয়েক বছর আগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তাকে সোনা চোরাচালানের একটি মামলায় গ্রেফতার করেছিল। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদ মর্যাদার ওই পুলিশ কর্মকর্তার নাম লুবনা মোস্তফা কাকন। তিনি বর্তমানে ডিএমপির ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে কর্মরত।

জানতে চাইলে সিআইডির ইকোনোমিক ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাঠ পর্যায় বা তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে এসে অনেকেই তদবির করছেন। কিন্তু আমরা কোনও তদবিরকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। অনুসন্ধানে যাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করা হবে।’

গত বছরের ২০ নভেম্বর মেরুল বাড্ডার ১৩ নম্বর সড়কের ৪১ নম্বর প্লটের গোল্ডেন মনিরের বাসায় অভিযান চালায় এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন- র‌্যাব। রাতভর অভিযান চালিয়ে তার বাসা থেকে অস্ত্র, গুলি, মাদক, ছয়শ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, বিদেশি মুদ্রাসহ নগদ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়। এরপর থেকেই গাউছিয়া মার্কেটের একজন সাধারণ কাপড় ব্যবসায়ীর অস্বাভাবিক উত্থানের বিষয়টি সামনে আসে। র‌্যাবের পক্ষ থেকেও সেসময় দুর্নীতি দমন কমিশন ও  সিআইডির কাছে মানি লন্ডারিং মামলার অনুসন্ধানের জন্য চিঠি পাঠানো হয়।গোল্ডেন মনিরের বাসা

সিআইডি সূত্র জানায়, তারা সম্প্রতি গোল্ডেন মনিরের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করলে একে একে তার সহযোগীদের নাম বেরিয়ে আসে। চার সহযোগী ছাড়াও সিআইডির কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে মনিরের স্ত্রী রওশন আক্তার ও ছেলে রাফি হোসেন, মনিরের মালিকানাধীন অটো কার সিলেকশন ও গ্র্যান্ড জমজমের দুই কর্মকর্তা আব্দুল হামিদ ও গোলাম হোসেনকে সিআইডি কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সূত্র জানায়, সিআইডি থেকে মনির ও তার সহযোগীদের সম্পদের খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করার পর থেকেই পুলিশ কর্মকর্তা লুবনা মোস্তফা কাকন তদবির শুরু করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শুরুতে সে মনির, তার স্ত্রী এবং সন্তানের জন্য ইনকোয়ারি অফিসারের কাছে তদবির শুরু করে। এরপর তার স্বামী হায়দার আলী, ভাসুর রিয়াজ উদ্দিন এবং কাউন্সিলর শফিকের জন্যও তদবির শুরু করে। আমরা তাকে সতর্ক করে দিয়েছি। পুলিশ কর্মকর্তা হয়েও এমন সেনসেটিভ মামলার প্রায় সব অপরাধীর জন্য তার দৌড়ঝাঁপ আমাদের বিস্মিত করেছে।’

তদবির বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার লুবনা মোস্তফা কাকন বলেন, ‘আমি আমার স্বামীর জন্য তদবির করতে গিয়েছিলাম। অন্য কারও বিষয়ে কিছু বলিনি। আমি পুলিশ কর্মকর্তা হলেও আমার স্বামীর জন্য আমি বলতেই পারি। সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্টদের আমি সত্য অনুসন্ধান করার জন্য বলেছি। যথাযথ অনুসন্ধান করলে আমার স্বামীর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগের সত্যতা পাবে না। আমাদের আয়কর ফাইলে আয়-ব্যয়ের সবকিছুই উল্লেখ রয়েছে।’

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আলোচিত গোল্ডেন মনিরের অন্যতম তিন সহযোগী হলো সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন, তার আপন ছোট ভাই হায়দার আলী ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম ওরফে সোনা সফিক। মনিরসহ এই চারজনের নামে যৌথ মালিকানায় একাধিক সম্পত্তির খোঁজ পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডের ২৩ ও ২৫ নম্বর প্লটের গ্র্যান্ড জমজম টাওয়ার। ২০ কাঠা জায়গার ওপর নির্মিত এই ভবনের বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় হাজার কোটি টাকা। এছাড়া উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ১০/এ সড়কের ৪ নম্বর প্লটের ওপর নির্মিতব্য বহুতল ভবনের মালিকও তারা চার জন। ৯০ কাঠা জমির ওপর নির্মিতব্য এই ভবনের স্থানটি তারা রাজউক কল্যাণ সমিতির কাছ থেকে নিয়েছিলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মনিরের সঙ্গে রিয়াজ, হায়দার ও সোনা সফিকের সম্পর্ক পুরানো। কথিত রয়েছে তারা একসঙ্গে গোল্ড স্মাগলিং করেন। একারণে মনির হোসেন মনিরকে সবাই গোল্ডেন মনির ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল ইসলামকে সোনা শফিক হিসেবে চেনে। এছাড়া রিয়াজ উদ্দিনকে ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট উত্তরা এলাকা থেকে ৬১ কেজি অবৈধ স্বর্ণ উদ্ধারের একটি মামলায় গ্রেফতার করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ- ডিবি।

সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, তারা এখন পর্যন্ত মনির হোসেনের স্থাবর সম্পত্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অটো কার সিলেকশন নামে একটি গাড়ির শো-রুম, গোলেন্ড গিয়ার, গালফ অটো কারস লিমিটেড, মনির বিল্ডার্স লিমিটেড, মনির ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনালের নাম পেয়েছেন। এগুলো তার একক মালিকানা প্রতিষ্ঠান। স্বদেশ প্রোপার্টিজ নামে একটি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানেও মনিরের ২৫ ভাগ শেয়ারের মালিকানা ছিল। এছাড়া মনির, রিয়াজ, হায়দার ও সফিকের যৌথ মালিকানায় রয়েছে গ্র্যান্ড জমজম টাওয়ার ও আল সাফা টাওয়ার। উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিনের নামে উত্তরার তিন নম্বর সেক্টরের ছয় নম্বর সড়কে একটি বাড়ি, সাত কাঠার একটি প্লট, গাজীপুরের আনসার একাডেমীর পাশে ৬৭ শতাংশ জমির ওপর ডায়িং কারখানা, কোনাবাড়ীতে একটি গার্মেন্টস কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। হায়দারের নামে যৌথ মালিকানায় জমজম ও আল সাফা টাওয়ারের বাইরে উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরের ৩০ নম্বর সড়কে একটি ৮ তলা বাড়ি রয়েছে।

সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, মনির ও তার সহযোগীদের আরও স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ কোথায় আছে তা জানার জন্য ভূমি রেজিস্ট্রেশন কার্যালয়, এনবিআরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। একইসঙ্গে ব্যাংকের তরল হিসাবে কত টাকা লেনদেন এবং কত টাকা এফডিআর রয়েছে তা জানার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্স্যিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটেও চিঠি দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন- 

গোল্ডেন মনিরের বাসায় মিললো ৬০০ ভরি স্বর্ণ, কোটি টাকা, পিস্তল

অবৈধ অস্ত্র ও মাদকসহ গোল্ডেন মনির গ্রেফতার

রাজউকের সিল নকল করে গোল্ডেন মনিরের কব্জায় ২০০ প্লট!