বৈশাখের তীব্র গরমে বদলে গেছে আদালতে চিত্র। যেখানে আদালতের আইনজীবী, বিচারকরা কোর্ট-টাই, গাউন পরে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন, সেখানে তারা শুধু সাদা জামার ওপরে টাই পরে শুনানি করছেন। তীব্র গরমে চিরচেনা সেই কালো কোর্ট-গাউন এখন আর নেই। স্থান পেয়েছে সাদা শার্ট ও কালো টাই অথবা নেকব্যান্ড।
এর আগে চলমান তাপপ্রবাহে অধস্তন দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত, ট্রাইব্যুনালগুলোর বিচারক ও আইনজীবীদের মামলা পরিচালনাকালীন নির্ধারিত পোশাক পরিধানের বিধান শিথিল করে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নির্দেশক্রমে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. গোলাম রব্বানীর সই করা এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ৮ এপ্রিল থেকে পরবর্তী নির্দেশ প্রদান না করা পর্যন্ত এই নির্দেশনা বলবৎ থাকবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
পোশাকের বাধ্যবাধকতা শিথিল হলেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে আদালত সংশ্লিষ্টদের। সপ্তাহখানেক ধরে সকাল সাড়ে ৯টা বাজামাত্রই রোদের তাপমাত্রা প্রায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে। গলায় টাই, হাতে মামলার ফাইল নিয়ে এক কোর্ট থেকে আরেক কোর্টে ছুটছেন আইনজীবী। সবার পরনে কালো প্যান্টের সঙ্গে সাদা শার্ট আর কালো টাই। এক আদালত থেকে আরেক আদালতে ছোটাছুটিতে গলদঘর্ম তারা। অপরদিকে মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানা থেকে বাঁচতে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তীব্র যানজট ঠেলে আদালত আসতে বাধ্য হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। অনেকেই এই তীব্র গরম সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুমুখে ঢলে পর্যন্ত পড়েছেন।
গত ২২ এপ্রিল থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে সারা দেশের হিটস্ট্রোকের তথ্য মনিটরিং করা হচ্ছে। মঙ্গলবার কন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হয়, গত সাত দিন সারা দেশে হিটস্ট্রোকে ১০ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে আরও পাঁচ জন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
এদিকে বাংলাদেশের আবহাওয়া বিভাগ আবারও তাপপ্রবাহ সম্পর্কিত সতর্কতা জারি করেছে। অব্যাহত তাপপ্রবাহের মধ্যে রবিবার (২৮ এপ্রিল) জারি করা সতর্কতায় বলা হয়, সকাল থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা চলমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে। ঢাকাসহ দেশের প্রায় ৪৫টির বেশি জেলায় তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ফলে তীব্র গরম অনুভূত হওয়ায় সারা দেশেই জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমন বাস্তবতায় মানুষ যেভাবে পারছেন, তাপ থেকে বাঁচতে অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এমন পরিস্থিতিতে সারা দেশের মতো গরমের তীব্রতায় আদালত প্রাঙ্গণে হাঁসফাঁস অবস্থায় বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা। একটু শান্তি পেতে আদালতের সময়ের পরিবর্তন চাইছেন আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা। রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর থেকে সকাল ৮টার দিকে ঢাকার জজ কোর্টে আসেন আইনজীবী ওবায়দুল কাদের। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এর আগে কোর্টে আসতাম সকাল সাড়ে ৯টার দিকে। এখন ৮টার মধ্যে কোর্টে পৌঁছাতে বাধ্য হচ্ছি। কিছু দিন ধরে যে গরম পড়েছে তাতে বাসে যাতায়াত করা অনেক কঠিন কাজ।’
তিনি আরও বলেন, ‘সকালে আদালতে এসেও শান্তি নেই। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গরমের তীব্রতা আরও বাড়তে থাকে। কোনোরকম কাজ শেষ করে চেম্বারে গিয়ে বসে হাঁফ ছাড়েন আইনজীবীরা। এরপর বিকাল ৫টা বাজা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। বিকালে কিছুটা গরম কম থাকে। তখন বাসায় ফিরতে কিছুটা কষ্ট কম হয়। তবে দেশে যে অবস্থা চলছে, রমজান মাসের মতো করে কোর্টের সময় পরিবর্তন হলে সবার জন্য ভালো হতো।’
ঢাকার জজ কোর্টে নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন অ্যাডভোকেট আজাদ রহমান। তিনি বলেন, দেশে যেভাবে তাপপ্রবাহ চলছে, কোর্টের সময় পরিবর্তন করা খুব জরুরি। এই গরমে বয়োজ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিছু কিছু কোর্ট (এজলাস) এতটাই সংকীর্ণ যে বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের দাঁড়ানোর মতো পর্যাপ্ত জায়গাও হয় না। তার ওপরে অধিকাংশ বিচারিক আদালতের কক্ষে এয়ার কন্ডিশন (এসি) নেই। এর মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করা কতটা কষ্টকর বলে বোঝানো যাবে না।
প্রত্যেকটি বিচারিক আদালত কক্ষে এয়ার কন্ডিশন (এসি) বসানো কিংবা কোর্টের সময় পরিবর্তনের দাবি জানান এই আইনজীবী।
কোতোয়ালি থানার মানবপাচার আইনের এক মামলায় হাজিরা দিতে ডেমরা থেকে আদালতে আসেন বিচারপ্রার্থী শাওন সাজু। তিনি বলেন, আইনজীবীরা তো কাজ শেষে চেম্বার গিয়ে বসতে পারেন। আমাদের বটতলায় বসা ছাড়া সেই সুযোগও নেই। তীব্র গরমে কতক্ষণই বা গাছতলায় বসা যায়। আদালতের এজলাসে মানুষের গরম, বাইরে তাপমাত্রার গরম; এই পরিস্থিতির মধ্যে বেঁচে আছি এটাই অনেক কিছু। তবে আদালতের কার্যক্রমের সময় পরিবর্তন হলে এই গরমে কিছুটা হলেও কষ্ট লাঘব হবে।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের নিরাপত্তা বিষয়ে দায়িত্বরত এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের কিছুটা হলেও এই গরমে চেম্বার বা বটতলায় বসার জায়গা রয়েছে। কিন্তু আমাদের এই গরমে একই ড্রেসে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়। অধিকাংশ বিচারিক এজলাসে এসি নেই। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আদালতে মানুষের এত পরিমাণ চাপ বাড়ে, সেই সঙ্গে গরমও বাড়ে। মাঝে মধ্যে মনে হয়, এই বুঝি আমার হিটস্ট্রোক হলো নাকি! ইতোমধ্যে আমাদের অনেক পুলিশ সদস্য গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বিচারিক কার্যক্রম কিছুটা শিথিল হলে সবার জন্য মঙ্গলজনক।
আরও পড়ুন: