ওই তিন খুনি হলেন কুষ্টিয়ার মীরপুর উপজেলার রাজনগর গ্রামের সাফায়েত হোসেন হাবিব (কয়েদি নম্বর ৭১৩৩/এ),একই উপজেলার কুর্শা গ্রামের আনোয়ার হোসেন (কয়েদি নম্বর ৭৫৮৯/এ) ও রাশেদুল ইসলাম ঝন্টু (কয়েদি নম্বর ৭৫৯০/এ) ।
যশোর পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান জানান,ফাঁসি কার্যকরের জন্য তাকেসহ জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের কাছে কারাকর্তৃপক্ষ চিঠি পাঠিয়েছেন।
জানা গেছে, এরই মধ্যে কারা কর্তৃপক্ষ ফাঁসির রায় কার্যকরের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। প্রস্তুত রাখা হয়েছে জল্লাদকে। প্রস্তুত ফাঁসির মঞ্চও। ফাঁসির রায় কার্যকরকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো সমস্যা না হয়,সেজন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
যশোর কারাগারের জেলার মহিউদ্দিন হায়দার জানিয়েছেন, সেখানে একসঙ্গে সর্বোচ্চ দু’জনের ফাঁসি কার্যকর করা যায়। সেই কারণে দু’জনের ফাঁসি সম্পন্ন হওয়ার ২০ মিনিট পরে আরেক জনের ফাঁসি কার্যকর করা হবে।
ঘটনা :
১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের কালিদাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে সন্ত্রাসবিরোধী এক জনসভায় চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নিহত হন কাজী আরেফ আহমেদ,কুষ্টিয়া জেলা জাসদের সভাপতি লোকমান হোসেন,সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলী,স্থানীয় জাসদনেতা ইসরাইল হোসেন ও সমশের মণ্ডল।
ঘটনার পরদিন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার এসআই মোহাম্মদ ইসহাক আলী বাদি হয়ে ২৯ জনের নামে মামলা করেন। পরে আদালত ২৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরু করেন।
মামলার বিচার শেষে ২০০৪ সালের ৩০ আগস্ট রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত দায়রা জজ ১০ আসামিকে ফাঁসি ও ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ১০ আসামি হলেন ইলিয়াস,রাশেদুল ইসলাম ওরফে ঝন্টু, সাফায়েত হোসেন হাবিব, আনোয়ার হোসেন, শাহিরুদ্দিন, মান্নান মোল্লা, বাকের, রওশন, জাহান ও জালাল। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, রাফাত ওরফে রাফা,গারেস,তাসিরুদ্দিন,আসগর জোয়ারদার,নজরুল ইসলাম,ওয়ালিউর রহমান,একুব্বার,টিক্কা ওরফে জব্বার, লাবলু,ফিরোজ ওরফে ফরু,লাল্টু ওরফে নুরুজ্জামান।
পরে আসামিরা হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০০৮ সালের ৫ আগস্ট হাইকোর্ট আপিলের রায়ে ৯ জনের ফাঁসি বহাল রাখেন। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তদের খালাস দেওয়ার পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শাহিরুদ্দিনকেও খালাস দেওয়া হয়।। পরে হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ লিভ টু আপিলের আবেদন করেন।
অন্যদিকে,মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকায় ইলিয়াস হোসেন,রাশেদুল ইসলাম ঝন্টু ও আনোয়ার হোসেন হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন।
২০১১ সালের ৬ আগস্ট আপিলের রায়ে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখা হয়। ফলে ইলিয়াস,রাশেদুল ও আনোয়ারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে। এরমধ্যে আনোয়ার হোসেন ও রাশেদুল ইসলাম ঝন্টু রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। রিভিউ আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে তা খারিজ করা হয়।
যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র সুপার শাজাহান আহমেদ জানিয়েছেন, ফাঁসি কার্যকরের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। নির্দিষ্ট সময় তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হবে।
এদিকে কারাগারে একটি সূত্র জানিয়েছে,বুধবার বিকেলে জেল সুপার,জেলারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ফাঁসির মঞ্চের প্রস্তুতি পরিদর্শন করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে,ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ৯ আসামির মধ্যে ৫ জন শুরু থেকেই পলাতক রয়েছেন। এছাড়া আটক চারজনের মধ্যে ইলিয়াস হোসেন কারাগারেই মারা গেছেন। অন্য তিনজনের ফাঁসির রায় আজ কার্যকরের পথে।
প্রতিক্রিয়া :
কাজী আরেফ আহমেদের স্ত্রী রওশন জাহান সাথী তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন,‘কাজী আরেফ একজন জাতীয় রাজনীতিক। স্বাধীনতার অন্যতম রূপকার;তার নৃশংস হত্যাকাণ্ডে শুধু পরিবার নয়,দেশের স্বাধীনতাকামীরা থমকে গেছে।’
তিনি বলে আদালতের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। কিন্তু প্রশ্ন একটা থেকে যায়,কেন অন্য পলাতক আসামিদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না?’
তিনি বলেন,‘এই মামলার অপর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মান্নান মোল্যা এমন কোনো অপরাধ নেই যা তিনি করেননি। তাকে কেন ধরা হচ্ছে না তা জানতে চাই্।‘
জেলা জাসদের সভাপতি অ্যাডভোকেট রবিউল আলম বলেন,‘আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা সম্পর্কে যে কথাটি প্রচলিত,কাজী আরেফসহ ৫ নেতার খুনের রায় কার্যকরের মধ্যদিয়ে তা আরেকবার প্রমাণ হচ্ছে।’
তবে দেরিতে হলেও যে রায় কার্যকর হচ্ছে-তাতে স্বস্তি যেমন আছে,তেমনি ন্যায়বিচার পাওয়ার বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার ঘটাবে-যোগ করেন তিনি।
কাজী আরেফ আহমেদ
কাজী আরেফ আহমেদ ১৯৪২ সালে কুষ্টিয়ার ঝাউদিয়া নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে ছাত্রলীগের মাধ্যমে তার রাজনীতিতে পদার্পণ করেন তিনি। ১৯৬২ সালের নভেম্বরে সিরাজুল আলম খান,আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য ঐকমত্যে পৌঁছান। এটাই নিউক্লিয়াস নামে পরিচিত। যার নেতৃত্বে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন গড়ে ওঠে।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণা করলে ছাত্রলীগ মহানগর শাখার সভাপতি কাজী আরেফ দৃঢ় সমর্থন ও একাত্মতা প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি ৬ দফার আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের গণআন্দোলন,১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দক্ষ সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তিনি মুজিব বাহিনীর উপ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। এই বাহিনীর নেতা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম রণাঙ্গনের (বৃহত্তর পাবনা,কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, খুলনা ও বরিশাল) নেতৃত্ব দেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কাজী আরেফ আহমেদ সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এজন্য এরশাদের আমলে কারাভোগ করেন। জাসদ বিভক্ত হলে কাজী আরেফ জাসদের (ইনু) কার্যকরী সভাপতি হন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুন:প্রতিষ্ঠা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তিনি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআদালত গঠন করেন। সেসময় আসম আবদুর রব ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদের সর্বশেষ দুটি অংশ একত্রীভূত হলে কাজী আরেফ ৭ সদস্য বিশিষ্ট জাসদ পুনর্গঠন কমিটির সদস্য হন।
তৎকালীন গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বলিষ্ঠ মুখপাত্র দৈনিক গণকণ্ঠের ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
কাজী আরেফ আহমেদ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন ও স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগে ভর্তি হন। আন্দোলন সংগ্রাম ও আইয়ুবী নির্যাতনের কারণে মাস্টার্স ডিগ্রি সমাপ্ত করতে পারেননি।
১৯৭৪ সালে ছাত্রলীগ সাবেক নেত্রী রওশন জাহান সাথীকে তিনি বিয়ে করেন। তাদের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
/জেবি/এমএসএম/আপ-এনএস/