‘গেলো ৫ বছরের তুলনায় সড়কে এবার ঈদে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েছে’

বিগত ৫ বছরের তুলনায় এবছর ঈদুল আজহায় সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি দুটোই বেড়েছে। ঈদযাত্রায় দেশের সড়ক-মহাসড়কে ২৪০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর এসব দুর্ঘটনায় ২৭৩ জন নিহত এবং ৪৪৭ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সমিতি। সংস্থাটির হিসাবে, সড়ক, রেলপথ ও নৌপথ মিলে মোট দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৬২টি। এতে নিহত ২৯৫ জন ও আহত হয়েছেন ৪৮৮ জন। 

আজ শুক্রবার (৩০ জুলাই) সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচাস্থ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন-২০২১ প্রকাশকালে এ তথ্য তুলে ধরেন। সংগঠনটির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেল বহুল প্রচারিত ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় দৈনিক, আঞ্চলিক দৈনিক ও অনলাইন দৈনিক-এ প্রকাশিত সংবাদ মনিটরিং করে এই প্রতিবেদন তৈরি করে।

প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার কারণ ও দুর্ঘটনা রোধে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। এতে জানানো হয়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে কঠোর লকডাউনের কারণে ঈদের সময় মাত্র আট দিন গণপরিবহন চলাচল করে। এর আগে-পরে কঠোর বিধিনিষেধের কারণে সব মোটরযান বন্ধ ছিল। তবে জরুরি প্রয়োজনে এ সময়ও অনেকেই ব্যক্তিগত গাড়িতে ঢাকায় ফিরেছেন। ঈদযাত্রা শুরুর দিন গত ১৪ জুলাই থেকে ঈদের পর ২৮ জুলাই পর্যন্ত তথ্য হিসাব করে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, লকডাউনের কারণে মানুষের যাতায়াত সীমিত ছিল। তবে স্বল্প সময়ের জন্য গণপরিবহন চালু করায় সড়কে গণপরিবহনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত যান, বিশেষ করে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা-ব্যাটারিচালিত রিকশা, ট্রাক-পিকআপ ও কাভার্ডভ্যানে একসঙ্গে গাদাগাদি করে যাতায়াত করেছে। 

উল্লেখিত সময়ে রেলপথে ৯টি ঘটনায় ১১ জন নিহত ও পাঁচ জন আহত হয়েছে। নৌ-পথে ১৩টি দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত ও ৩৬ জন আহত এবং ২১ জন নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা মিলেছে। সড়ক, রেল ও নৌপথে যৌথভাবে ২৬২টি দুর্ঘটনায় ২৯৫ জন নিহত ও ৪৮৮ জন আহত হয়েছে। তবে ২৩ জুলাই থেকে কঠোর লকডাউন শুরু হওয়ার পর ২৫ জুলাই থেকে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি কমতে থাকে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, বরাবরের মতো এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। এবারের ঈদে ৮৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৯৩ জন নিহত, ৫৯ জন আহত হয়েছে, যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৬ দশমিক ২৫ শতাংশ, নিহতের ৩৪ দশমিক ০৬ শতাংশ এবং আহতের ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ প্রায়।

এ সময় সড়কে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ৩১টি শিশু ও ৩৮ জন নারীও নিহত হয়েছেন। পেশাভিত্তিক হিসাবে ১০৬ জন চালক, ১৯ জন পরিবহন শ্রমিক, ৬৪ জন পথচারী, ১২ জন শিক্ষার্থী, তিন জন সাংবাদিক, পাঁচজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ১২ জন শিক্ষক, ছয় জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং একজন প্রকৌশলীর পরিচয় মিলেছে।

এরমধ্যে নিহত হয়েছে দুজন পুলিশ সদস্য, একজন সেনাবাহিনীর সদস্য, একজন বিজিবি সদস্য, ২৭ জন নারী, ১৭টি শিশু, নয় জন শিক্ষার্থী, নয় জন শিক্ষক, ৮৭ জন চালক, ১৬ জন পরিবহন শ্রমিক, ৫৩ জন পথচারী ও তিন জন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট যানবাহনের ২৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ মোটরসাইকেল, ২৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-লরি, ৭ দশমিক ৪১ শতাংশ কার-মাইক্রো-জিপ, ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ নছিমন- করিমন- ট্রাক্টর- লেগুনা- মাহিন্দ্রা, ১০ দশমিক ৩৮ শতাংশ অটোরিকশা, ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ ব্যাটারি রিকশা-ইজিবাইক-ভ্যান-সাইকেল ও ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ বাস এসব দুর্ঘটনা কবলিত হয়েছে।
 
সংঘটিত দুর্ঘটনার ২৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৪৪ দশমিক ২৫ শতাংশ পথচারীকে গাড়িচাপা দেওয়ার ঘটনা, ১৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনায়, ৭ দশমিক ৯১ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারণে ও ০ দশমিক ৮৩ শতাংশ চাকায় ওড়না পেঁছিয়ে এবং ০ দশমিক ৮৩ শতাংশ ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।

দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৪৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ১৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ ফিডার রোডে এবং ০ দশমিক ৮৩ শতাংশ রেল ক্রসিংয়ে হয়েছে। এছাড়াও সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ০ দশমিক ৮৩ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে সংঘটিত হয়।

যাত্রী-কল্যাণ-সমিতি

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বিগত ঈদগুলোতে সরকারের নানা মহলের তৎপরতা থাকায় দুর্ঘটনার লাগাম কিছুটা টেনে ধরা সক্ষম হয়েছে। এ বছর কঠোর লকডাউন পরে শিথিল করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি না থাকায় এবারের ঈদযাত্রায় সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি তুলনামূলক বেড়েছে।

‘সরকার সড়কের অবকাঠামোর উন্নয়নে যতটা মনোযোগী, সড়ক নিরাপত্তায় ততটা উদাসীন’- এমন অভিযোগ করে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বিগত একযুগে ধারাবাহিকভাবে সড়ক নিরাপত্তায় নানা প্রতিশ্রুতি, নানা চমকপ্রদ বক্তব্য, নানা আশ্বাস, নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনও কিছুই যেন বাস্তবায়নে আলোর মুখ দেখে না। এরইমধ্যে বাস্তবায়নের আগেই সড়ক আইন আরও দুর্বল করার ষড়যন্ত্র চলছে। ফলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সহ-সভাপতি তাওহীদুল হক লিটন, যুগ্ম মহাসচিব মনিরুল হক, প্রচার সম্পাদক আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।  

প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার যেসব কারণ তুলে ধরা হয়েছে-
১. লকডাউনের কারণে এবং স্বল্প সময়ের জন্য গণপরিবহন চালু করার ফলে মহাসড়কে ব্যক্তিগত যানবাহন, যেমন- প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা-ব্যাটারিচালিত রিকশা, ট্রাক-পিকআপ ও কাভার্ডভ্যানের বেপরোয়া গতিতে যাতায়াত।
২. জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন বা রোড মার্কিং, সড়কবাতি না থাকায় হঠাৎ ঈদে যাতায়াতকারী ব্যক্তিগত যানের চালকদের রাতে এসব জাতীয় সড়কে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চালানো।
৩. জাতীয়, আঞ্চলিক ও ফিডার রোডে টার্নিং চিহ্ন না থাকার ফলে নতুন চালকদের এসব সড়কে দুর্ঘটনায় পতিত হতে হয়েছে।
৪. মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা।
৫. উল্টোপথে যানবাহন চালানো, সড়কে চাঁদাবাজি, পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহন।

দুর্ঘটনার প্রতিরোধে যাত্রীকল্যাণ সমিতির সুপারিশ-
১. জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে রাতের বেলায় অবাধে চলাচলের জন্য আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা।
২. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ, যানবাহনের ত্রুটি সারানোর উদ্যোগ গ্রহণ।
৩. ধীরগতির যান ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা।
৪. সড়কে চাদাঁবাজি বন্ধ করা, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা সুনিশ্চিত করা।
৫. সড়কে রোড সাইন, রোড মার্কিং স্থাপন করা।
৬. সড়ক পরিবহন আইন যথাযতভাবে বাস্তবায়ন করা। ট্রাফিক আইনের অপপ্রয়োগ রোধ করা।
৭. গণপরিবহন বিকশিত করা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ’র অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
৮. মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও মেরামত সুনিশ্চিত করা, নিয়মিত রোড সেইফটি অডিট করা।