দেশের ইতিহাসে যাত্রীবাহী লঞ্চে আগুনের ‌‘এমন ঘটনা আর নেই’

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দুপুর পর্যন্ত ৩৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ দুর্ঘটনায় নিখোঁজ আছেন আরও অনেকেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ইতিহাসে অতীতে যাত্রীবাহী কোনও লঞ্চ বা জাহাজে এমন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আর নেই। এর আগে কখনও কখনও ডক ইয়ার্ডে মেরামতের সময়, যাত্রীবাহী লঞ্চের ইঞ্জিন কক্ষে বা কেবিন কক্ষে ‘ছোটখাটো আগুনের’ ঘটনা ঘটলেও কখনও প্রাণহানি হয়নি। পানির উপরে আগুনে পুড়ে এতো মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় লঞ্চ মালিক, যাত্রী ও নৌ মন্ত্রণালয়সহ সবাই হতবিহব্বল।

শীতের লেপ, কম্বল ও পোশাক থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে বলে ধারণা অনেকের; যা দাহ্য পদার্থ হিসেবে কাজ করে। অভিযান-১০ নামের এই লঞ্চটিতে পর্যাপ্ত জীবন রক্ষার সরঞ্জাম ও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল কিনা, তা তদন্ত করে দেখা হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

বরগুনার এক যাত্রী আমজাদ হোসেন। তার বয়স ৭০ পেরিয়েছে, ছোটবেলা থেকে লঞ্চে ঢাকা-বরগুনা যাতায়াত করেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি আমার জীবনে শুনিনি লঞ্চে কখনও আগুন লেগে মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, এটাই প্রথমবার শুনলাম।’ পানির ওপরে মানুষ অসহায় হয়ে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ায় লঞ্চের এই নিয়মিত যাত্রী শোকাহত।

অগ্নিকান্ড

আমজাদ হোসেনের এই দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ এর পরিচালক (ট্রাফিক) রফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমজাদ হোসেনের দাবি ঠিক। আমাদের জানা মতে, দেশে এমন ঘটনা অতীতে আর ঘটেনি। ডক ইয়ার্ডে কাজ করার সময় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আছে। তবে যাত্রীবাহী লঞ্চে আগুনের ঘটনা এবং প্রাণহানি এটাই প্রথম।’

তিনি বলেন, ‘এর আগে ডর্ক ইয়ার্ডে মেরামতে থাকা লঞ্চে, যাত্রীবাহী লঞ্চের ইঞ্জিন কক্ষে, কোনও একটি কেবিন বা কক্ষে আগুনের ছোটখাটো ঘটনা ঘটলেও বড় কোনও আগুনের ঘটনা নেই, এটাই প্রথম।’

রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘সাধারণত অনেকসময় ইঞ্জিন রুমে আগুনের ঘটনা ঘটে। সেখানে অগ্নিনির্বাপকের সকল ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু অভিযান-১০ এর ক্ষেত্রে আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি আগুন দোতলা থেকে সূত্রপাত হয়েছে। কীভাবে এই আগুনের সূত্রপাত হলো, তা আমরা তদন্ত করে দেখবো।’

তিনি বলেন, ‘লঞ্চে শীতের সময়ে প্রচুর লেপ, কম্বল ও শীতের পোশাক থাকে, অগ্নিকাণ্ডের পর হয়তো সেগুলো দ্রুত দাহ্য পদার্থ হিসেবে কাজ করছে। সবকিছুই তদন্তে বের হয়ে আসবে।’

অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন (3)

লঞ্চে অগ্নিনির্বাপক ও জীবন রক্ষার যেসব সরঞ্জাম থাকার কথা

লঞ্চে আপদকালীন সময়ে জীবন রক্ষার জন্য বেশকিছু সরঞ্জাম থাকার কথা। লঞ্চের ধারণ ক্ষমতা অনুসারে এসব সরঞ্জাম থাকার কথা। এরমধ্যে লাইফ-বয়া, লঞ্চের ছাদে ছোট বোট অন্যতম। তবে দেশের প্রতিটি লঞ্চেই ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী বহন করে। সপ্তাহের শেষ দিন থাকায় বৃহস্পতিবার লঞ্চটিতে অনেক যাত্রী ছিল। ঘটনার সময় সবাই ছিল ঘুমে। এজন্য প্রাণহানি বেশি হয়েছে, লঞ্চটিও ছিল মাঝনদীতে। তাছাড়া লঞ্চটি চলতে থাকায় বাতাসে আগুনে আরও ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিআইডব্লিউটিএ এর পরিচালক (ট্রাফিক) রফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লঞ্চে জীবন রক্ষার সরঞ্জাম থাকার কথা। সেটা কতগুলো ছিল, যাত্রীরা সেগুলো ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিল কিনা, তাও দেখার বিষয়।’

তিনি বলেন, ‘আগুন দোতালায় সূত্রপাত হলে সেখানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বা ফায়ার ইস্টিংগুইসার ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। তবে লঞ্চটির ছাদে কোন ছোট বোট ছিল না।’

অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন (2)

লঞ্চ মালিকরাও বলছেন, এটাই প্রথম ঘটনা

লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড ও মানুষের মৃত্যুর ঘটনা প্রথম শুনলেন বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির মহাসচিব শহীদুল হক। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি নিজেই এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অন্তত ১৫ বছর। এর আগেও এ বিষয়ে খোঁজ খবর রাখতাম। আমিও লঞ্চে এমন অগ্নিকাণ্ডের কথা আর শুনিনি। ঘটনার পর আমিও খোঁজ নিয়েছি, এমন ঘটনা আর অতীতে ঘটেনি। এটি কেন ঘটলো, কীভাবে ঘটলো তা তদন্ত করে বের করতে হবে।’

মহাসচিব বলেন, ‘কেউ বলছে, আগুনের সূত্রপাত মোটরসাইকেল, কেউ বলছে ছালার চট থেকে, কেউ বলছে ইঞ্জিন রুম থেকে আবার কেউ বলছে দোতলা থেকে। কিন্তু আগুন এতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো কীভাবে- তা আমরা খতিয়ে দেখছি। আমি সবসময় বলে আসছি, লঞ্চে যাতে মোটর সাইকেল ওঠানো না হয়, কিন্তু তারপরও লঞ্চে মোটরসাইকেল তোলা হয়। কারণ মোটরসাইকেলে পেট্রোল অকটেন থাকে, যা দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে।’

অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন (4)

শহীদুল বলেন, ‘কয়েক বছর আগে ডক ইয়ার্ডে থাকা আমার একটি লঞ্চ মেরামতের সময় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল, স্টোররুমে আগুন লেগেছিল, তখন কেবল স্টাফরা ছিল। তবে এরকম যাত্রাবাহী লঞ্চে আগুনের ঘটনা প্রথম। যখন লঞ্চটিতে আগুনের ঘটনা ঘটে, তখন যাত্রীদের সবাই ছিল ঘুমে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ হয়ে যায়।’

যাত্রী কল্যাণ সমিতি থেকে দেওয়া হবে দেড় লাখ করে টাকা

ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে যাত্রী কল্যাণ সমিতির তহবিল থেকে দেড়লাখ করে টাকা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএ এর পরিচালক (ট্রাফিক) রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি মন্ত্রী মহাদয় ঘোষণা করবেন। তাছাড়া দাফন কাফনের জন্য জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সমন্বয় করে আমরাও সহযোগিতা করবো।’