টক দইয়ে পুষ্টিগুণ বেশি, মহিষের দইয়ে ক্ষতিকর অণুজীব: গবেষণা

দেশে তৈরি নানা ব্র্যান্ডের মিষ্টি ও টক দই পরীক্ষা করে দেখেছেন গবেষকরা। গবেষণায় জানা গেছে, পুষ্টিগুনের দিক থেকে টক দই অনেক বেশি এগিয়ে। টক দইয়ের সবগুলো ব্র্যান্ডে উপকারী খনিজ—যেমন: সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালশিয়ামের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি পাওয়া গেছে মিষ্টি দইয়ের তুলনায়। তবে দেশের মহিষের দইয়ে পাওয়া গেছে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গে সংক্রমণের জন্য দায়ী অণুজীব ও ছত্রাকের উপস্থিতি; আর গরুর টক দই মানসম্মত।

দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ১০ রকমের দইয়ের যাবতীয় ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের উপস্থিতি এবং পুষ্টিগুন শনাক্ত করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। এই গবেষণার নমুনা বিশ্লেষণ করে তথ্য সুনিশ্চিতকরণের কাজ করেন অস্ট্রেলিয়ার নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ব্যারি মার্শালের গবেষণাগারের গবেষকরা। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে নেচার গ্রুপের ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ শীর্ষক নিবন্ধে।

গবেষকরা জানান, এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল তিনটি—আমাদের দেশের বিভিন্ন দইয়ের মধ্যে পুষ্টিগুনের তুলনা, ভারী ধাতব ও এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি যাচাই করে দেখা এবং বিভিন্ন অণুজীবের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি শনাক্তকরণ। সামগ্রিকভাবে দেশীয় দইয়ের খাদ্য নিরাপত্তার মান কেমন তা যাচাই করাই ছিল এই গবেষণার লক্ষ্য।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বিসিএসআইআর, বন গবেষণাগার, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীদের যৌথ এই গবেষণায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, রংপুর, মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া ও কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থান থেকে পর পর তিন মাস ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সংগ্রহ করা হয় এসব ব্র্যান্ডের দই।

এরপর পিসিআর, জেল ইলেকট্রোফোরেসিস, অ্যামপ্লিকন সিকোয়েন্সিং (সিক্সটিন এস ও আইটিএস), এটোমিক এবসরপশন, স্পেকট্রোফটোমেট্রি ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যবহার করে সম্পাদিত এই গবেষণায় দেখা যায়, দেশের অধিকাংশ টক দইয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ল্যাক্টোব্যাসিলাস এবং স্ট্রেপটোকক্কাস প্রজাতির অণুজীব পাওয়া গেছে; যা দুধ থেকে দই তৈরির অন্যতম প্রধান উপকরণ।

গরুর টক দই ও মিষ্টি দই এবং মহিষের টক দই মিলিয়ে মোট ৩০৬ রকমের ব্যাকটেরিয়া চিহ্নিত হয় এই গবেষণায়। এর মধ্যে ২৮ রকমের ব্যাকটেরিয়া সবগুলো দইয়ে পাওয়া গেছে। ল্যাক্টোব্যাসিলাস এবং স্ট্রেপটোকক্কাস ছাড়াও ল্যাক্টোকক্কাস ও এরোমোনাস ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে বেশিরভাগ দইয়ে। মিষ্টি দই এ দেখা গেছে ক্ল্যাভেরোমাইসেস ও ক্যান্ডিডা ছত্রাকের পরিমাণ বেশি।

গবেষণায় আরও জানা যায়, ল্যাক্টোব্যাসিলাস একটি অত্যন্ত উপকারী অণুজীব, যা হজমে সাহায্য করা এবং অন্য ক্ষতিকারক অণুজীবকে প্রতিহত করাসহ শরীরে বিভিন্ন ভূমিকা রাখে। স্ট্রেপটোকক্কাস প্রজাতিও হজম ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করে। এই দুইটি ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য দেশীয় টক ও মিষ্টি দইয়ে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি নির্দেশ করে।

তবে তুলনামূলকভাবে মিষ্টি দইয়ে উপকারী অণুজীবের পরিমাণ কম এবং কয়েকটি ব্র্যন্ডে স্ট্রেপটোকক্কাস অণুজীবের পাশাপাশি ক্ল্যাভিসপোরা প্রজাতির ছত্রাকের বিপুল পরিমাণে উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর পেছনে অতিরিক্ত চিনি বা অন্যান্য দ্রব্য মেশানো একটি কারণ হতে পারে বলে মনে করেন গবেষকেরা। ক্ল্যাভিসপোরা অতিরিক্ত চিনির উপস্থিতিতে বসবাস করতে পারে। এটি সরাসরি কোনও রোগের জন্য মারাত্মকভাবে দায়ী না হলেও খাবারকে তাড়াতাড়ি পচিয়ে ফেলতে এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে।

এ গবেষণায় আরও দেখা যায়, বেশকিছু ব্রান্ডের দইয়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‌‌‘জিঙ্ক’ পাওয়া যায়নি পর্যাপ্ত পরিমাণে। এটা মানবদেহের গঠন, বিকাশ ও প্রজননে সাহায্য করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র নির্দেশনা অনুযায়ী দই এর ক্ষেত্রে ৮-১১ মিলিগ্রাম/কেজি জিঙ্ক থাকতে হবে। কিন্তু দেশীয় দইয়ের ৭০ শতাংশে তা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়নি। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী দইয়ে ভিটামিন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, কপার, আয়োডিন, ফসফরাস, আয়রন, জিঙ্ক এর উপস্থিতি দইয়ের পুষ্টিগুন নিশ্চিত করে। দেশের কয়েকটি টক দইয়ের ব্র্যান্ডে এর সবগুলো উপাদানই পাওয়া গেছে। কিন্তু বেশ কিছু দই বিশেষত মিষ্টি দইয়ে পুষ্টি উপাদান তুলনামূলকভাবে কম পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে, পাঁচটি ব্রান্ডের দইয়ে কপারের উপস্থিতি পাওয়া গেছে স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বেশি মাত্রায়। তবে, তা বিশেষ ক্ষতিকারক মাত্রায় পাওয়া যায়নি। অনেক দইয়ে টোটাল ফ্যাটের (মোট চর্বি জাতীয় উপাদান) পরিমাণ খুবই কম (মিষ্টি দই এ অধিকাংশ ক্ষেত্রে)। অন্যদিকে অধিকাংশ মিষ্টি দইয়ে টোটাল সলিড (মোট শক্ত/ দৃঢ় পদার্থ) এবং সলিড-নন-ফ্যাট এর পরিমাণ স্বাভাবিকের দ্বিগুণ, যা দই থেকে ফ্যাট অপসারণ এবং দইয়ে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংমিশ্রণ করার ইঙ্গিত দেয়। 

গবেষণায় বলা হয়, মহিষের দইয়ে নগণ্য পরিমাণে ল্যাক্টোব্যাসিলাস এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে এন্টারোব্যাকটার, এসিনেটোব্যাক্টার, শিগেলা, ক্লেবসিয়েলা, সাইট্রোব্যাক্টার ও এরোমোনাস প্রজাতির অণুজীব পাওয়া গেছে, যা মানবদেহের বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী হতে পারে। এর কারণে পাকস্থলির সংক্রমণ, ডায়রিয়া ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। এদের মধ্যে এন্টারোব্যাকটার প্রজাতির অণুজীব সাধারণত গবাদী পশুর মলমূত্রে পাওয়া যায়; যা এসব প্রাণীর অন্ত্র সংক্রমণের জন্য দায়ী।

এছাড়াও মহিষের দইয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ছত্রাক পাওয়া গেছে, যাতে আছে ক্যান্ডিডা, আয়োডোফেনাস, এপিওট্রাইকাম ও ট্রাইকোস্পোরণ। এই ছত্রাকগুলো চুলকানি ও চামড়ায় সংক্রমণ, হজমে সমস্যা এবং রক্তে বিষক্রিয়ার জন্য মারাত্মকভাবে দায়ী। গবেষকেরা মনে করেন মহিষের দইয়ের লবণাক্ত এবং ভিন্ন মাত্রার স্বাদ অবিক্রিত রাখার জন্য দুধ থেকে দই প্রক্রিয়াজাত করণের সময় তা পর্যাপ্ত পরিমাণে ফোটানো হয় না, যা দইয়ে সংক্রামক অণুজীবের উপস্থিতি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

গবেষকরা বলছেন, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া এই গবেষণা প্রকল্প সমাপ্ত হয় ২০২১ এর আগস্ট মাসে। বাজারের শীর্ষস্থানীয় টক ও মিষ্টি দইয়ের ব্র্যান্ডগুলোতে এন্টিবায়োটিক, আর্সেনিক বা ভারী ধাতব পদার্থ—উল্লেখযোগ্যভাবে পাওয়া যায়নি এই গবেষণায়।

এটিকে বেশ আশাবাদী একটি ব্যাপার বলে মনে করছেন প্রধান গবেষক অধ্যাপক এস এম রফিকুল ইসলাম। তার মতে, এটি দইয়ের নিরাপদ খাদ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়। দেশে যেহেতু খুব বেশি মহিষের দই বিএসটিআই অনুমোদিত নেই, তাই একটিমাত্র জনপ্রিয় মহিষের দইয়ের নমুনা চট্টগ্রাম থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে; যা প্রাথমিকভাবে মহিষের দইয়ের মাঝে বিভিন্ন অণুজীবের উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য বিশ্লেষণ করা হয়। তবে দেশের মহিষের দইয়ের পূর্ণঙ্গ চিত্র বুঝতে সবগুলো প্রচলিত মহিষের দই নিয়ে গবেষক দলের কাজ করার পরিকল্পনা আছে বলে জানান তিনি। এই গবেষণার পরের ধাপে গবেষকদের ২৫টি ভিন্ন ভিন্ন প্রকরণের দই নিয়ে কাজ করার লক্ষ্য আছে বলেও তিনি জানান। উল্লেখ্য, দই এর সব ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক একসঙ্গে চিহ্নিতকরণের এ রকম গবেষণা এটিই বাংলাদেশে প্রথম।

নেচার রিসার্চ এর ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক এস এম রফিকুল ইসলাম। সহ-প্রধান গবেষক ছিলেন একই বিভাগের শিক্ষক আদনান মান্নান এবং অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার মার্শাল সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজ এর গবেষক আলফ্রেড চ্যান এবং কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোহাম্মদ জাভেদ ফয়সাল।

গবেষকদলে ডেইরি বিশেষজ্ঞ হিসেবে ছিলেন ছিলেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অধ্যাপক জুনায়েদ সিদ্দিকি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক ড. মো. নাজমুল হক।

এছাড়াও গবেষক দলে ছিলেন-বাংলাদেশ ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট‌, চট্টগ্রামের গবেষক মোহাম্মদ জাকির হোসেন, বিসিএসআইআর চট্টগ্রামের বিজ্ঞানী গোলাম মোস্তফা ও আবু বক্কর সিদ্দিক। গবেষণাগারে পুরো কাজটি সম্পাদন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফসানা ইয়াসমিন তানজিনা ও মেহেদী হাসান রুমি।