পরিবহন শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দেবে কে?

মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরে সব শ্রেণির শ্রমিকদের কম-বেশি উৎসব ভাতা থাকলেও বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের পরিবহন শ্রমিকরা। নির্ধারিত মাসিক বেতন নেই বলে বোনাস বা উৎসব ভাতা পান না তারা। দৈনিক মজুরি বা ট্রিপ চুক্তি অনুযায়ী সারা বছরই পরিবহনের চালকসহ গাড়ির স্টাফরা বেতন নেন। মালিকরা সেভাবেই বেতন দিয়ে অভ্যস্ত। তবে তাদের ঈদ বা পূজায় কোনও উৎসব ভাতা দেওয়া হয় না। বোনাস বা উৎসব ভাতা বলতে বাসের যাত্রীদের কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া অর্থ। পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে।

সূত্র জানিয়েছে, পরিবহন শ্রমিকদের কাঠামোগত মজুরির পরিবর্তে গণপরিবহন মালিকরা দৈনিক ইজারার ভিত্তিতে বাস, হিউম্যান হলার, টেম্পু, অটোরিকশা প্রভৃতি যানবাহন চালকদের হাতে তুলে দেন। বাংলাদেশে একজন চালক রাস্তায় শত প্রতিকূলতার মধ্যে গণপরিবহনটি পরিচালনার পাশাপাশি দিনভিত্তিক মালিকের ইজারা, দৈনন্দিন জ্বালানি ও আনুষঙ্গিক খরচ, চালকের নিজের এবং হেলপারের বেতন আয় করতে গিয়ে অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। এতেই পরিবহনে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।

পরিবহন শ্রমিক ও চালকরা জানিয়েছেন, বিদ্যমান শ্রম আইন ও পরিবহন আইনে পরিবহন শ্রমিকদের জন্য কয়েকটি গ্রেডে বেতন পরিশোধের বিধান রাখা হলেও তা কার্যকর করা যায়নি। সেখানে একজন পরিবহন শ্রমিকের দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের কথা বলা আছে। এর বেশি হলে ওভারটাইম দেওয়ার বিধান রয়েছে।

গ্রেড অনুযায়ী, একজন চালকের মাসিক বেতন হওয়ার কথা ২০ হাজার ৮০০ টাকা। কিন্তু শ্রমিক ও চালকরা বেতন পান ট্রিপ অনুযায়ী। পরিবহন নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি সংস্থা-বিআরটিএ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) বিষয়টি দেখভালের কর্তৃপক্ষ হলেও অনেকটাই উদাসীন সংস্থাটি।

দূরপাল্লার বাসগুলোয় কর্তব্যরত চালক ও শ্রমিকরা বেতন পান ট্রিপ ভিত্তিতে। সেখানে বোনাসের কোনও সুযোগ নেই।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবহন শ্রমিক লীগ নেতা হানিফ খোকন বলেন, ‌‘পরিবহন মালিকরা মাসিক বেতনে অভ্যস্ত নয়। তারা ট্রিপ ভিত্তিতে বেতন দেয়। শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে সেভাবেই কাজ করে।’ তিনি জানান, গাড়ির রুট পারমিট নিতে বিআরটিএতে যে সব কাগজপত্র জমা দিতে হয়, সেখানে চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সের কপিও জমা দিতে হয়।

‘পরিবহন মালিকরা প্রয়োজনীয় সব কাজগজপত্রের সঙ্গে গাড়ির চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সের কপিও দেন। কিন্তু সেই চালক কে কোথায় গাড়ি চালান তা পরিবহন মালিক জানেন, বিআরটিএ জানে আর আল্লাহ জানেন! আমরা জানি না। অপরদিকে বিদ্যমান শ্রম আইন অনুসারে পরিবহন চালক ও শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দেওয়ার বিধান রয়েছে। এই বিধানটিও কার্যকর করা যায়নি।’

হানিফ খোকন আরও বলেন, ‘পরিবহন শ্রমিক ও চালকদের কোনও মাসিক বেতন নেই। তারা ট্রিপ অনুযায়ী বেতন নেন। তাদের কোনও বোনাস দেওয়া হয় না। বোনাস বলতে যাত্রীদের কাছ থেকে যে ১০-২০ টাকা করে আদায় করেন তাই।’

এ প্রসঙ্গে ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির সাধরণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘পরিবহন শ্রমিকদের বেতন-বোনাস বকেয়া নেই। মালিকরা তা ঈদের আগেই পরিশোধ করে দেন। এ নিয়ে কোনও ঝামেলা হয় না।’

এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘বিআরটিএতে রুট পারমিটের জন্য যে চালকের কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়, পরে তিনি চাকরি নিয়ে অন্যত্র চলে যান—এটা ঠিক। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।’

পরিবহন শ্রমিকদের ছুটি প্রসঙ্গে খন্দকার এনায়েত উল্লাহ জানান, পরিবহন খাতে কর্মরত শ্রমিকদের ছুটি নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। কারণ প্রতিটি গাড়ির জন্যই দুজন করে চালক ও হেলপার রয়েছে। একজন কাজ করার পরের দিন অপরজন কাজ করে, এটাই নিয়ম। গাড়ি যেহেতু বন্ধ রাখা হয় না, সেহেতু এভাবেই চলতে হয়।’

এদিকে সোহাগ পরিবহনের চালক রুস্তুম আলী (ছদ্মনাম) বলেন, ‘২৬ বছর গাড়ি চালাই। কখনোই মাসিক বেতন পাইনি। মালিকরা মাসিক বেতনে চালক রাখতে চান না। কারণ মাসিক বেতনে চালক বা শ্রমিক রাখলে তাদের আইন অনুযায়ী অন্যান্য সুবিধা দিতে হয়। মালিকরা তা দিতে রাজি নন। ট্রিপ অনুযায়ী, বেতন নিলে তাদের সুবিধা। ট্রিপ দিয়ে এলে চুক্তি অনুসারে বেতন নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যাই। মালিকদেরও দায়িত্ব শেষ। বোনাস বা উৎস ভাতার কোনও প্রশ্নই আসে না।’

এ দিকে সড়ক খাতের সব শ্রমিককে ঈদ বোনাসসহ এক মাসের পূর্ণাঙ্গ বেতন ১৫ রমজানের মধ্যে পরিশোধের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ দাবি জানান।

একই সঙ্গে তিনি করোনাভাইরাস মহামারিতে কর্মহীন পরিবহন শ্রমিকদের নিয়োগ ও কর্মঘণ্টা বা দিনভিত্তিক মজুরির বিপরীতে কাঠামোগত মজুরি নির্ধারণ করে ন্যূনতম খেয়ে পরে বেঁচে থাকার অধিকার দিতে পরিবহন মালিক ও সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।

বিবৃতিতে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘পরিবহন শ্রমিকদের কাঠামোগত মজুরির পরিবর্তে গণপরিবহন মালিকরা দৈনিক ইজারার ভিত্তিতে বাস, হিউম্যান হলার, টেম্পু, অটোরিকশা প্রভৃতি যানবাহন চালকদের হাতে তুলে দেন। আমাদের দেশে একজন চালক রাস্তায় শত প্রতিকূলতার মধ্যে গণপরিবহনটি পরিচালনার পাশাপাশি দিনভিত্তিক মালিকের ইজারা, দৈনন্দিন জ্বালানি ও আনুষঙ্গিক খরচ, চালকের নিজের এবং হেলপারের বেতন ওঠাতে গিয়ে অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন।’