আমন এবং বোরো মৌসুমে অধিকহারে ফলন দিতে সক্ষম ধানের জাত শনাক্ত করেছেন বাংলাদেশের গবেষকরা। নতুন ধানের জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি কৃষকের মাঠে ‘হেড টু হেড অন-ফার্ম অ্যাডাপটিভ ট্রায়াল’ পরিচালনা করছেন তারা। এর মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদনশীলতা ও মুনাফা বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সর্বোত্তম ফলন দিতে সক্ষম— এমন ধানের জাত শনাক্ত করা হয়েছে বলে মনে করেন তারা। বৃহস্পতিবার (২১ এপ্রিল) বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) এবং বিআরই’র যৌথভাবে আয়োজিত এক কর্মশালায় গবেষণালদ্ধ এসব ফলাফল উপস্থাপন করা হয়।
কর্মশালায় জানানো হয়, ধান বিজ্ঞানীরা নতুন ধানের জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি কৃষকের মাঠে সর্বোত্তম ফলন দিতে সক্ষম এমন অনেকগুলো ধানের জাত শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন জাতের ফলনের তুলনা ও নিবিড় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আমন এবং বোরো উভয় মৌসুমেই সেরা ফলন দেওয়া ধানের জাত শনাক্ত করেছেন তারা। এই জাতগুলো সারা দেশে সম্প্রসারণ করা গেলে চাষিদের উৎপাদন এবং মুনাফা উভয়ই বৃদ্ধি পাবে। গবেষণাটির বিআরআই অংশের ফলাফল উপস্থাপন করেন ড. মো. হুমায়ুন কবির, মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং প্রধান, ফলিত গবেষণা বিভাগ, বিআরআই এবং ইরি অংশের ফলাফল উপস্থাপন করেন ইরি’র বিজ্ঞানী এবং সাউথ এশিয়া– সিড সিস্টেম অ্যান্ড প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টের প্রধান ড. স্বাতী নায়েক।
২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ কোটি ৮৭ লাখ টন চাল উৎপাদন করে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। হেড টু হেড অন-ফার্ম অ্যাডাপটিভ ট্রায়ালে গবেষকরা দেখেছেন, বর্তমানে ব্রি ধান ৮৮, ব্রি ধান ৯৬ এবং ব্রি ধান ৯২ বোরো মৌসুমের সেরা ফলন প্রদানকারী ধানের জাত। রোপা আমান মৌসুমে, আইআর১- ৩এফ৪৪১ এবং ব্রি ধান ৭৯ আকস্মিক বন্যা-প্রবণ পরিবেশের কার্যকরি জাত। এছাড় ভারতীয় ধানের জাত স্বর্ণার বিকল্প হিসেবে দেশের উত্তরাঞ্চলে ব্রি ধান ৯৩, ব্রি ধান ৯৪ এবং ব্রি ধান ৯৫ সবচেয়ে জনপ্রিয়, তবে মাঠ পর্যায়ে আমনের সর্বোচ্চ ফলন প্রদানকারী জাত হচ্ছে ব্রি ধান ৮৭।
বিগত তিন বছর যাবত দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি হেড টু হেড অ্যাডাপটিভ ট্রায়াল (এইচএইচএটি) পরিচালনা করার পর গবেষকরা এই ধানের জাতগুলো চিহ্নিত করেছেন বলে জানানো হয়। তারা পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও পরিমাণগত ডেটা তৈরির মাধ্যমে জনপ্রিয় পুরানো মেগা জাতের তুলনায় নতুন উদ্ভাবিত জাতের উৎপাদনশীলতা পর্যবেক্ষণ করার জন্য ইচএইচএটি ট্রায়াল পরিচালনা করেন। এই ট্রায়ালে নতুন-উদ্ভাবিত উফশী জাত, আগে চাষকৃত বেঞ্চমার্ক জাত এবং কৃষক-পর্যায়ের স্থানীয় জাতগুলোর উৎপাদনশীলতা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য একমাঠে একত্রে চাষ করে উল্লিখিত ফলাফল পাওয়া যায়। এছাড়াও গবেষণাটির মাধ্যমে বিভিন্ন সম্ভবনাময় জাত এবং জাতগুলোর বিভিন্ন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ট্রায়ালে গবেষকরা কৃষক এবং কৃষি সম্প্রসারণকর্মীদের কাছ থেকে এসব জাত সম্পর্কে মতামত সংগ্রহ করেন। এছাড়া এই ট্রায়াল কৃষকের মাঝে কৌতূহল, জ্ঞান এবং নতুন জাতের কার্যকরি চাহিদা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, গত বোরো মৌসুমে উফশী জাতের মধ্যে সর্বনিম্ন ফলন দিয়েছে ব্রি ধান ২৮ এবং জাতটিতে বিভিন্ন পোকা-মাকড়ের প্রকোপও ছিল বেশি। তাই এই জাতটিকে অবিলম্বে প্রতিস্থাপন করা উচিত বলে মনে করেন ধানবিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণ কর্মীরা। এছাড়া ব্রি ধান ২৯ এবং ব্রি ধান ৮৯-এর ফলন প্রায় সমান হয়েছে। তবে কিছু কিছু জায়গায় ব্রি ধান ২৯ নেক ব্লাস্ট রোগে সংক্রমিত হয়েছিল।
ইরি’র বিজ্ঞানী এবং সাউথ এশিয়া সিড সিস্টেম অ্যান্ড প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টের প্রধান ড. স্বাতী নায়েক বলেন, ‘এই ধরনের অন-ফার্ম ট্রায়াল আমাদের পুরনো জাতগুলোর তুলনায় নতুন জাত কতটা বেশি ফলনশীল, সে বিষয়ে জানতে সাহায্য করবে। নতুন উদ্ভাবিত ও অবমুক্তকৃত ধানের জাতগুলো যে সব অঞ্চলে চাষ করা হবে, সেসব অঞ্চলের পরিবেশগত দিক বিবেচনা করে উদ্ভাবন করা হচ্ছে। আমাদের গবেষণার মাধ্যমে নতুন জাতগুলো যথেষ্ট উন্নত কিনা, অথবা কৃষক ও দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতির জন্য জাতগুলোর আরও উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে কিনা, সেসব বিষয় সম্পর্কেও জানা গেছে।’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর। তিনি বলেন, ‘দেশে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য যে পরিবেশের জন্য যে উফশী জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, সেটি সেই অঞ্চলেই চাষাবাদ করা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে সম্প্রসারণ কর্মীদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকায় এই জাতগুলোকে কৃষকদের কাছে সহজলভ্য করা এবং যাতে তাদের সার্বিক উৎপাদন এবং মুনাফা বৃদ্ধি পাবে এবং তাদের জীবনের মান উন্নয়নে সহায়তা করবে।’