ঈদে ই-কমার্স

ফেসবুকে সক্রিয় অনলাইন প্রতারক চক্র

ঈদকে সামনে রেখে অনলাইনে প্রতারক চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পেজ খুলে বাহারি পোশাক বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে তারা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। গত কয়েকদিনে এমন একাধিক চক্র গ্রেফতার হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে। গত ২৫ দিনে রাজধানী থেকেই অন্তত ১৭ জন ‘প্রতারক’ গ্রেফতার হয়েছে।

রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে এসব চক্রকে শনাক্ত করে পিবিআই, সিআইডি ও ডিবি।

গত ২৫ এপ্রিল রাজধানীর মিরপুর থেকে মোসা. জান্নাতুল ফেরদাউস ওরফে কাজল (২৮) ও এসএম খায়রুজ্জামানকে (৩৭) গ্রেফতার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। কাজল ‘তাবিহা শাড়ী হাউজ’ নামের একটি পেজ পরিচালনা করতো। সে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলতো।

রোদাইনা জান্নাত শেখা নামে এক নারী ওই ফেসবুক পেজে এ বছরের ৭ জানুয়ারি দুটি শাড়ির অর্ডার দেন। তার কাছ থেকে বিকাশে পুরো টাকা নেওয়ার পরও শাড়ি দেয়নি কাজল। উল্টো তার নম্বর ব্লক করে দেয় সে। 

এ ঘটনায় রোদাইনা জান্নাত শেখার স্বামী এ বছরের মার্চে ডেমরা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন।

মামলাটি পিবিআই তদন্ত শুরু করে। এরপর ওই দুজনকে গ্রেফতার করে পিবিআই।

যেভাবে প্রতারণা করা হচ্ছে

গত ৭ জানুয়ারি রোদাইনা জান্নাত ‘তাবিহা শাড়ী হাউজ’ নামের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে ভারতীয় দুটি শাড়ি অর্ডার দেন। অগ্রিম ৪৫০ টাকা পেজের মালিককে বিকাশও করেন তিনি। পরের দিন রোদাইনা জান্নাতকে একজন ডেলিভারিম্যান ফোন করে বলেন, ‘আপনার পণ্য আমার হাতে, আমি এখন নয়াপল্টনে আছি। পেজের মালিকের কাছ থেকে প্রোডাক্ট কোড দিলে আমি শাড়ি ডেলিভারি দেবো।’ তখন পেজে দেওয়া নম্বরে ফোন দেন রোদাইনা। তাবিহা শাড়ি হাউজের পেজের পরিচালক কাজলকে ফোন দেওয়ার পর সে জানায়, পুরো টাকা পেইড করতে হবে, অন্যথায় ডেলিভারি ম্যান যাবে না। অগ্রিম দেওয়া ৪৫০ টাকা ফেরতও দেওয়া হবে না।

এরপর রোদাইনা আরও টাকা বিকাশ করেন। কিছুক্ষণ পর কোড চাইলে ‘অর্ডার কোড’ আসতে সমস্যা করছে অপেক্ষা করেন বলে তাকে জানানো হয়। পরে পেজের পরিচালক আবার ফোন দিয়ে বলেন, ‘আপনার অর্ডার দুইটা, দুইটার টাকা পেইড করতে হবে।’ রোদাইনা জান্নাত তখন টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে তার পাঠানো টাকা ফেরত চান। জবাবে বলা হয়, আমাদের কোম্পানির নিয়ম অগ্রিম টাকা ছয় মাস পর ফেরত দেওয়া হয়।

এই কথা শুনে রোদাইনা জান্নাত পুনরায় অপর অর্ডারের ১ হাজার ৩৫০ টাকা বিকাশে পাঠায়। যাতে তিনি তার শাড়ি পান। এর পর পেজের নম্বরে অসংখ্যবার ফোন দিলেও তারা ফোন রিসিভ করেনি। উল্টো রোদাইনা জান্নাতকে পেজ থেকে এবং মোবাইল নম্বর ব্লক করে দেয় তারা।

রোদাইনা জান্নাত বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন। এরপর তার স্বামী ডেমরা থানায় মামলা করেন। গ্রেফতার করা হয় প্রতারক চক্রের সদস্য মোসা. জান্নাতুল ফেরদাউস ওরফে কাজল ও তার স্বামী এসএম খায়রুজ্জামানকে। তাদের গ্রামের বাড়ি নড়াইলের কালিয়া এলাকায়।

প্রতারক চক্রের সব কৌশল প্রায় একই ধরনের। কথার ফাঁকে ক্রেতাদের আটকে দেয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগ গত ১৭ এপ্রিল রাজধানীর হাজারীবাগের শংকর এলাকা থেকে অনলাইন ব্যবসায় প্রতারণার অভিযোগে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে। অনলাইনে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করায় তাদের গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন মো. বাপ্পি হাসান, মো. আরিফুল ওরফে হারিসুল, মো. সোহাগ হোসেন, মো. বিপ্লব শেখ ও নুর মোহাম্মদ।

গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ব্যবহার অযোগ্য ও অতি নিম্ন মানের পুরনো ছেঁড়া শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রি পিসসহ বিভিন্ন পণ্য-সামগ্রী জব্দ করা হয়। এছাড়া প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত আইফোন, ল্যাপটপ ও ২১টি অনলাইন শপিং পেজ জব্দ করা হয়।

উপ-পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা-লালবাগ) মো. রাজীব আল মাসুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঈদকে সামনে রেখে অনেকেই মার্কেটে গিয়ে ঝামেলা এড়াতে অনলাইনে কেনা-কাটা করছেন। এ সুযোগে কিছু প্রতারক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আকর্ষণীয় ড্রেসের কমমূল্যে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ তাদের বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি অর্ডার করে প্রতারিত হচ্ছেন।’

গ্রেফতারকৃতদের প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘অনলাইন প্রতারক চক্রের এ সদস্যরা ফেসবুক পেজ খুলে ভালো মানের পণ্যের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে কেউ অর্ডার করলে এসএ পরিবহনের মাধ্যমে অর্ডারকৃত মালামাল সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু গ্রাহক যখন পার্সেলটি বাসায় নিয়ে খোলেন তখন নিম্নমানের ব্যবহারের অযোগ্য ও নষ্ট মালামাল দেখে হতভম্ব হয়ে যান। গ্রাহকরা যখন ওই নম্বরে ফোন দেন তখন আজ না কাল বলতে থাকে এবং একসময় তাকে ব্লক করে দেন।’

গ্রেফতারকৃতদের এই চক্রের বিরুদ্ধে হাজারীবাগ থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

পুলিশের পরামর্শ

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অর্গানাইজড ক্রাইম-দক্ষিণ) মো. সারোয়ার জাহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনলাইন থেকে কেনাকাটা করার সময় চটকদার বিজ্ঞাপন না দেখে, প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বস্ত কিনা তা বুঝে কেনাকাটা করতে হবে। তাহলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ কম থাকে। কেউ প্রতারিত হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানাতে হবে। তাহলে প্রতারক চক্রকে প্রতিহত করা যাবে।’