‘সকাল সাতটার দিকে দোকানে আসি, এরপর বিকাল চারটা-সাড়ে চারটা পর্যন্ত দোকান করে বাসায় গিয়ে রান্নাবান্না করি। সন্ধ্যার দিকে আবার দোকানে আসি, রাত সাড়ে ৯টা-১০টা পর্যন্ত থাকি। বাসায় ফিরে সব গোছাতে-গোছাতে রাত একটা-দেড়টা বাজে। পরে ঘুমাতে যাই।’ প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি নারী মরিয়মের প্রতিদিনের গল্পটা এভাবেই সাজানো। স্বামী শফিক মালের সঙ্গে পাঁচ ছেলে-মেয়ের সংসারের হাল ধরে আছেন তিনি।
মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার আন্তর্জাতিক মা দিবসকে সামনে রেখে বাংলা ট্রিবিউনের কথা হচ্ছিল রাজধানীর একজন কর্মব্যস্ত মা মরিয়মের সঙ্গে। এই শহরে মরিয়মের মতো আরও অগণিত মা-ও হাল ধরে রেখেছেন সংসারের জীবিকার। শনিবার (৭ মে) বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা হয় আরও কয়েকজন কর্মজীবী মায়ের। যারা নিজেদের পরিবারে ‘সবার পরে ঘুমাতে গিয়ে সবার আগে জেগে ওঠা মানুষ’, যাদের ওপর নির্ভর করে চলেছে পরিবার।
ঘর-সংসার ও দোকান পরিচালনা— একজন মা হিসেবে দুটোই সামলে নিচ্ছেন মরিয়ম। বয়স চল্লিশের কোঠায় পড়লেও অবয়ব ও শারীরিক দক্ষতায় বার্ধক্যের ছাঁপ উঁকি দিচ্ছে মাথার চুলে। পরিশ্রমলব্ধ জীবন নিয়ে তবুও হাসি মরিয়মের মুখে। জানালেন, বরিশালের গৌরনদী থেকে ঢাকায় বেড়াতে এসে ফুফুদের মধ্যস্থতায় তার বিয়ে হয়েছিল শফিক মালের সঙ্গে।
বিয়ের পর থেকে মরিয়ম সংসার সামলে মা হয়েছেন পাঁচ সন্তানের। স্বামীর সঙ্গে শক্ত হাতে ধরেছেন জীবিকার হাল। হাসিমুখে বললেন, ‘আল্লায় চালায়া নেয়, মিলিয়ে-ঝিলিয়ে চলি।’ এই ‘মিলঝিলে’র নতুন সংযোজন তার উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ কর্মমুখী দুই মেয়ে। বছরদেড়েক আগে দুই বড় মেয়ে বেসরকারি দুটো হাসপাতালে চাকরি পাওয়ার পর থেকে সাংসারিক টানাপোড়েনে কিছুটা লাগাম এসেছে। তবে আর্থিক সঙ্গতি বলতে ছোট দোকানটাই। এখনও নিজেদের স্থায়ী কোনও সংস্থান যোগাতে পারেননি মরিয়ম দম্পত্তি। এই সংস্থান কবে হবে, তাও অনিশ্চিত মরিয়মের। তিন জন ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা চলছে প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে।
সংসার জীবনে ফুরসত পাননি মরিয়ম। ২৪ ঘণ্টার বিরামহীন ব্যস্ততার মাঝে নিজেকে আলাদা করে দেওয়ার মতো সময়ের কথা তিনি মনে করতে পারেননি। এই প্রতিবেদকের প্রশ্নে তার ভাবলেশহীন জবাব ছিল— উনি (স্বামী শফিক) নিজেও ঘুরতে যান না, আমারেও নিয়ে যায় না। ছেলেমেয়েদের উনি কয়, ‘ঘুইরা কিছু করতে পারছস নাকি, কী করবি ঘুইরা’। মুখ টিপে হেসে দেন মরিয়ম।
‘করোনা শুরুর পর মেয়েকে আমার মায়ের কাছে রেখে আসি’ উল্লেখ করে জয়শ্রী মজুমদার লতা বলছিলেন তার প্রতিদিনকার ‘যুদ্ধে’র কথা। বলেন, ‘সকাল থেকে শুরু হয় আমার সারা দিনের যুদ্ধ। বাসায় অসুস্থ শ্বশুর। দেখাশোনার দায়িত্বটুকু আমারই। সকালে শ্বশুরের খাবার তৈরি করে মেয়েকে মায়ের কাছে রেখে অফিসে যাই। অফিসের ব্যস্ততায় বাসার কথা তখন ভুলে যাই। অফিস থেকে সন্ধ্যায় মায়ের বাসায় ফিরে মেয়েকে নাস্তা করিয়ে আবার নিজের বাসায় ফেরত যাই। রাতের খাবারের সব আয়োজন শেষে মেয়েকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে কখন যে নিজে ঘুমিয়ে যাই, জানি না।’
তবুও যেন কর্মজীবী মায়ের প্রতি সামাজিক প্রত্যাশার অভাব পূরণ হয় না। রাশি-রাশি প্রত্যাশার চাপে পড়ে মুখ বুজে ‘প্রত্যাশিত মা’ হয়ে ওঠার লড়াইটাও চলে নীরবে। শিক্ষক ও সংগঠক শ্যামলী শীল বলছিলেন, ‘‘নানা কারণে এখনও আমাদের দেশে মায়েদের নানাভাবে গিল্টি ফিল হয়। একজন মা প্রকৃত ‘মা’ হতে সক্ষম হয়েছে কিনা। চারপাশের সমাজ কী আশা করে? নারীদের কাছে প্রত্যাশার বড় বিষয় হচ্ছে— একজন নারী মা হিসেবে কতটা ভালো।’’
‘এই আমাকেই সারাক্ষণ চ্যালেঞ্জে থাকতে হয়, ছেলের রেজাল্ট ভালো হচ্ছে কিনা।’ এভাবে পরিস্থিতি তুলে ধরছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শ্যামলী শীল। তার ভাষ্য, ‘মা হিসেবে পুরোপুরি সফল হতে পারবো কিনা, সারাক্ষণ ব্যালেন্স করতে হয়। অনেক চাহিদা পূরণ করার প্রেসার আছে।’
শ্যামলী শীল উল্লেখ করেন, আমাদের দেশে মাতৃত্বের সংকট যেভাবে দেখানো হয়, এর বাইরেও ওভার অকুপায়েড হচ্ছেন গৃহিণীরা। সংসার করছেন, সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যেতে হয়, স্কুলের বাইরে বসে থাকতে হয়। কেন বসে থাকতে হয়? কারণ, নিরাপত্তা।’
সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক শ্যামলী শীল বলেন, ‘‘সমাজ যদি নিরাপদ হতো, তাহলে মায়েদের চিন্তা কমে যেতো। ফলে, চিন্তার বিষয় হচ্ছে কোন ধরনের সমাজে আমরা মা হচ্ছি। আমাদের দেশে ‘কমিউনিটি হেল্পিং’ পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রকে এর দায়িত্ব নিতে হবে।’’
দীপ্ত টিভির ভয়েস ডিরেক্টর জয়শ্রী মজুমদার লতা তার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘ব্যস্ততার দিনগুলোর মাঝেও দাওয়াত, শপিং, অসুস্থতা, আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেওয়া, সবকিছুতে সমান দৃষ্টি রাখতে হয়। কখনও আমার সন্তানের মা, আবার কখনও আমার মা-বাবার মা হয়ে দায়িত্ব পালনে এতটাই ব্যস্ত থাকি যে, ভুলে যাই শেষ কবে আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে খুব ভালো করে দেখেছিলাম। তবুও এই ক্লান্তিহীন ব্যস্ততা, ছোটাছুটি সবকিছুই হারিয়ে যায়— যখন কাছের মানুষগুলোর মুখে খুশির হাসি দেখতে পাই। এই ক্ষমতার জন্যই নিজেকে নারী হিসেবে ভাবতে খুব গর্ববোধ করি আমি।’
সংসার সামলে জীবিকার হাল ধরে গর্ববোধ করেন পান্থপথের ‘এক টেবিলে চায়ের’ দোকানি সালেহা বেগম (ছদ্মনাম)। দুই সন্তান আর স্বামীসহ বসবাস করেন পাশের কাঁঠালবাগান এলাকায়। শনিবার (৭ মে) বিকাল চারটার দিকে চায়ের অর্ডার নিতে নিতে নিজেদের সংগ্রামের কথা বলছিলেন হিজাব পরা সালেহা। তিনি বলেন, ‘দোকান মূলত দেখে আমার হাজব্যান্ড। আমাদের দুই সন্তান। উনি যখন কাজে যান, দোকানের মালামাল আনতে যান, তখন আমি বসি। উনি বিশ্রাম নিতে গেলে আমি দোকানে বসি।’
মা দিবসের আয়োজন
বিশ্বে প্রচলিত মা দিবসের সূচনা হয় ১৯০৮ সালে। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিকভাবে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মায়েদের জন্য উৎসর্গ করে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মা দিবস পালিত হয়ে আসছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনও আয়োজন না থাকলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নানা উপায়ে তা উদযাপন করে।
দিবসটি উপলক্ষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাণী দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন আয়োজন করে থাকে। এ বছর তার ব্যতিক্রম হয়নি। এদিন ঢাকায় ‘রত্মগর্ভা মা’ পদক প্রদান অনুষ্ঠান করবে আজাদ প্রোডাক্টস। এ বছর আয়োজনটির ১৯তম পর্ব মঞ্চায়ন হবে ঢাকা ক্লাবের স্যামসন এইচ চৌধুরী মিলনায়তনে।