ই-সিগারেটের বাজার ধরতে টার্গেটে বাংলাদেশ

দেশের কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস তথা উদীয়মান তামাকজাত পণ্যের (ই-সিগারেট, ভ্যাপিং) ব্যবহার বাড়ছে। এই সুযোগে আন্তর্জাতিক হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট (এইচটিপি) ব্যবসায়ীদের নজর পড়েছে বাংলাদেশের বাজারে।

বিভাগীয় ও জেলা শহরে এসব তামাকজাত পণ্য ছড়িয়ে পড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। উদীয়মান তামাকজাত পণ্যের বর্জ্য স্বাস্থ্যের পাশাপাশি পরিবেশের জন্যও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এখনই এসব নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

উল্লেখ্য, এ ধরনের পণ্য নিষিদ্ধ করেছে ভারতসহ বিশ্বের ৩২টি দেশ।

 

দাপট বাড়ছে ই-সিগারেটের

ই-সিগারেট, ভ্যাপিং ও হিটেড টোব্যাকো মূলত ব্যাটারিচালিত এক ধরনের যন্ত্র। এর ভেতর থাকে নিকোটিনের দ্রবণ যা ব্যাটারির মাধ্যমে গরম হয়। এতে তৈরি হয় ধোঁয়া। যা মস্তিষ্কে ধূমপানের অনুভূতি তৈরি করে।

গত কয়েক বছরে বিশ্বে ইলেকট্রনিক সিগারেটের প্রচলন বেড়েছে। তবে ইউরোপসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে এটি নিষিদ্ধ।

ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ (ডাব্লিউবিবি) ট্রাস্টের স্বাস্থ্য অধিকার বিভাগের প্রধান সৈয়দা অনন্যা রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ই-সিগারেটের বিপদজনক বর্জ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবন বিপন্ন করে তুলছে। এসব পণ্যে থাকা ধাতু, প্লাস্টিক ও ব্যাটারি বর্জ্য বাড়িয়ে তুলছে। ধোঁয়াবিহীন তামাকের প্লাস্টিকের পাউচ বা প্যাকেটগুলো পড়ছে রাস্তা, ড্রেন ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায়। এগুলো ভূগর্ভস্থ পানিও বিষাক্ত করে। যা পরোক্ষভাবে খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে মানুষ ও গবাদিপশুর শরীরে প্রবেশ করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশে যখন আইনটি করা হয়, তখন ই-সিগারেটের প্রচলন ছিল না। তাই এ নিয়ে আইনে কিছু বলা নেই। এর সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। আমরা এটি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছি।’

তামাকবিরোধী গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছে, বাংলাদেশে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস-এর ব্যবহার বাড়লেও এগুলো নিয়ন্ত্রণে কোনও পদক্ষেপ নেই। কৌশলী প্রচারের কারণে এসব পণ্যের জনপ্রিয়তা ও ব্যবহার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।’

 

ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস নিষিদ্ধ কেন জরুরি

২০২১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রকাশিত গবেষণায় ই-সিগারেটসহ সকল ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টকে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর চিহ্নিত করা হয়।

তাতে বলা হয়, শিশু-কিশোরদের মধ্যে যারা এসবে আসক্ত হয়, তাদের মধ্যে পরে সিগারেটে আসক্তির আশঙ্কা থাকে দ্বিগুণেরও বেশি। ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি পণ্যগুলো তামাকের ‘গেটওয়ে’ হিসেবে কাজ করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

ইউএস সার্জন জেনারেল রিপোর্ট ২০১৬-এ ই-সিগারেটসহ নিকোটিনযুক্ত সকল পণ্যকে ‘অনিরাপদ’ অভিহিত করা হয়েছে।  বিশেষ করে ২০১৯ সালে ই-সিগারেট বা ভ্যাপিং-সৃষ্ট শ্বাসযন্ত্রের জটিলতা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে মহামারির আকার ধারণ করলে এই ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টসগুলো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালে ফুসফুসজনিত রোগে ভর্তি হওয়া ২,৮০৭ জন রোগী ও তাদের মধ্যে ৬৮ জনের মৃত্যুর সঙ্গে ই-সিগারেট বা ভ্যাপিংয়ের যোগসূত্র থাকার কথা নিশ্চিত করেছে।

বাংলাদেশে এর প্রভাব নিয়ে এখনও কোনও গবেষণা হয়নি।

 

শিশু-কিশোররাই টার্গেট

মূলত শিশু-কিশোর ও তরুণদের টার্গেট করে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস উৎপাদন ও বাজারজাত করছে তামাক কোম্পানিগুলো। সুগন্ধির ব্যবহার ও আকর্ষণীয় নকশার কারণে কিশোরদের মধ্যে এসব তামাকপণ্যের জনপ্রিয়তা বাড়ছে বলে মনে করে প্রজ্ঞা।

ডব্লিউএইচও-এর ২০২১ সালের তথ্যমতে, বাজারে ১৬ হাজার ফ্লেভারের ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে— মাত্র একবছরের ব্যবধানে সেখানকার স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে ই-সিগারেটের ব্যবহার ৭৮ শতাংশ বেড়েছিল।

 

বাংলাদেশে নজর

দেশের ক্যাম্পাস, তরুণদের আড্ডাস্থল, বিভিন্ন মার্কেট ও রাস্তার মোড়ে গড়ে ওঠা ভ্যাপিং ক্লাবে হিটেড টোব্যাকো পণ্যের ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়েছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বিক্রয়কেন্দ্র।

ফেসবুকেও ব্যাপক হারে ই-সিগারেট সামগ্রী নিয়ে আলোচনা, বিক্রয় ও হাতবদল হচ্ছে।

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরিচালিত হয় বলে এতে ইমার্জিং টোবাকো প্রোডাক্ট ব্যবহারের প্রকৃত চিত্র পাওয়া কঠিন।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০১৭ সালে পরিচালিত এক পরিসংখ্যানে বাংলাদেশে ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহারের হার ০.২ শতাংশ দেখা গেছে।

সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪৯ শতাংশই তরুণ, যাদের বয়স ২৪ বছর বা তার নিচে। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন নির্ভরশীলের চেয়ে কর্মক্ষম মানুষ বেশি।

তামাক কোম্পানিগুলোও এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে তাদের ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট-এ আসক্ত করার চেষ্টায় আছে। এজন্য তারা ই-সিগারেট, ভ্যাপিং ও হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টগুলোকে ‘নিরাপদ বিকল্প’ হিসেবে নীতিনির্ধারকদের সামনে উপস্থাপন করে থাকে বলে মনে করেন স্বাস্থ্যবিদরা।

প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো আরেক দফা আইনের সংশোধন চাচ্ছে। সেখানে আমরা ছয় দফা দাবি জানিয়েছি। তার মধ্যে অন্যতম হলো— হিটেড টোব্যাকো, ই-সিগারেট তথা ইমার্জিং টোব্যাকো নিষিদ্ধের দাবি। এসবের উৎপাদন, আমদানি নিষিদ্ধেরও দাবি জানিয়েছি। ইতোমধ্যে ৩২টি দেশ এসব নিষিদ্ধ করেছে।’

দেশে বৈধ-অবৈধ দুভাবেই এসব পণ্য আসে। বিশেষ করে চীন থেকে বেশি আসে।

এ বি এম জুবায়ের বলেন, ‘দুই তিন বছর আগে এনবিআর ঘোষণা দিয়েছিল, ট্যাক্স দিয়ে এসব পণ্য দেশে আনা যাবে। তাই কেউ কেউ ট্যাক্স দিয়েও আনছে। অতিরিক্ত ছড়ানোর আগেই এটি বন্ধ হওয়া উচিত।’