সড়ক দুর্ঘটনা হঠাৎ বাড়লো যে কারণে

সম্প্রতি বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিনই সড়কে ঝরছে প্রাণ। এর পেছনে চালকদের বেপরোয়া আচরণসহ সড়কে অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা ও আইনের প্রয়োগের অভাবকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, প্রকৌশলগত কিছু সমস্যার সমাধান এবং কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ালে সড়কে মৃত্যু কমবে।

বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) দুপুরে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের উজিরপুরে যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে মাইক্রোবাসের ৬ যাত্রী নিহত জন। ২০ জুলাই বরিশালের বাকেরগঞ্জে বাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংঘর্ষে মারা যান ৫ জন। ২১ জুলাই গোপালগঞ্জে ট্রেনের ধাক্কায় নসিমনে থাকা ১৪ জন নির্মাণ শ্রমিকের মধ্যে ৫ জন ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান।

২২ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সাইনবোর্ড এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাস উল্টে ২০ জন আহত হন। একই দিন ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চলিক মহাসড়কে ট্রাক ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংঘর্ষে নারীসহ দুজন মারা যান।

২২ জুলাই দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে ট্রাকচাপায় মারা যান এক বৃদ্ধা। এদিন সকালে রংপুর-কুড়িগ্রাম আঞ্চলিক মহাসড়কের বেইলি ব্রিজ বাজার এলাকায় বাসচাপায় এক অটোরিকশাচালকের মৃত্যু হয়।

 

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সড়কে দুর্ঘটনা এত বেড়ে যাওয়ার পেছনে বড় কারণ হলো- আইন প্রয়োগের অভাব, সমন্বয়হীনতা, চালকদের প্রশিক্ষণে ঘাটতি। এ ছাড়া প্রতিযোগিতা, মহাসড়কে নসিমন, ইজিবাইক, রিকশাসহ ছোট যানবাহনের চলাচল এবং পথচারীদের অসচেনতাও দায়ী।’

 

তথ্য বলছে, ২১ জুলাই রাজধানীর বংশালে রিকশা থেকে ছিটকে পড়ে ইডেন মহিলা কলেজের এক ছাত্রী মারা যান। ২০ জুলাই রংপুর সদরের পাগলা পীর এলাকায় বাসচাপায় মোটরসাইকেলের আরোহীসহ দুজন মারা যান। ১৯ জুলাই ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে বাস, কাভার্ডভ্যান, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও পিকআপের চতুর্মুখী সংঘর্ষে তিন জন মারা যান।

 

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এসব দুর্ঘটনার পেছনে প্রকৌশলগত কিছু কারণ রয়েছে। সড়ক তৈরিতে সমন্বয়হীনতা, নির্মাণের ব্যবস্থাপনায় ত্রুটিও অন্যতম কারণ।’

তার পর্যবেক্ষণ, মোটাতাজা করা মহাসড়কের সঙ্গে গ্রামীণ সড়ককে সংযুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। এতে দ্রুত ও কম গতির যানবাহনের সংঘর্ষ হচ্ছে বেশি। বিপুল সংখ্যক যানযাবহনের ফিটনেস না থাকাতেও দুর্ঘটনা ঘটছে। স্থানীয়ভাবে তৈরি প্রায় ৪০-৫০ লাখ অবৈধ যানও গুরুতর সমস্যা তৈরি করছে মহাসড়কে। মহাসড়ক ও গ্রামীণ সড়কের সংযোগ বন্ধ করতে হবে। চার লেন রেখে সার্ভিস লেন বানাতে হবে।

 

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির ১৯ জুলাই প্রকাশিত পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ঈদুল আজহার যাত্রায় ১৫ দিনে (৩-১৭ জুলাই) ৩১৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। তাতে ৩৯৮ জন নিহত, ৭৭৪ জন আহত হয়েছে। আগের ঈদযাত্রার চেয়ে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ২৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ, নিহত বেড়েছে ৩১ দশমিক ৪১ শতাংশ।

বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, ৫-১৬ জুলাই ২৭৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৩১১ জন নিহত এবং ১ হাজার ১৯৭ জন আহত হয়েছে। গত চার বছরের ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা এবারই সর্বোচ্চ।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সময়ে দুর্ঘটনার শিকার হওয়া মোট যানবাহনের ২৯.০৩ শতাংশ মোটরসাইকেল, ২৩.১৮ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ড ভ্যান-লরি, ৫.৬২ শতাংশ কার-মাইক্রো-জিপ, ৩.৯৮ শতাংশ নছিমন-করিমন-ট্রাক্টর-লেগুনা-মাহিন্দ্রা, ১১.৪৭ শতাংশ অটোরিকশা, ৯.৩৬ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইক-ভ্যান-সাইকেল ও ১৭.৩৩ শতাংশ বাস।

 

‘দূরপাল্লার গণপরিবহনে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে’ উল্লেখ করে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘এর পেছনে কিছু কারণ আমরা চিহ্নিত করেছি। এগুলো হলো— বেপরোয়া গতি, জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন বা সড়কবাতি না থাকা, জাতীয়, আঞ্চলিক ও ফিডার রোডে টার্নিং চিহ্ন না থাকা, মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা। উল্টোপথে যান চালানো, সড়কে চাঁদাবাজি ও পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহনও বড় কারণ। এছাড়া, মোটরসাইকেল, ইজিবাইক, অটোরিকশার সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতেও দুর্ঘটনা বাড়ছে।’

 

এ বিষয়ে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনিস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ডিভাইডার বিহীন রাস্তাগুলোতে হয়েছে। আমাদের চালকদের যে আচরণ, তাতে সব রাস্তায় ডিভাইডার লাগবে। পথচারীর জন্য নিরাপদ ফুটপাত না থাকায়ও মৃত্যু বাড়ছে। দুর্ঘটনা এড়াতে সরকারকে সড়ক ব্যবস্থাপনায় আরও মনোযোগী হতে হবে।’