কমছে না ছিনতাই, বাড়ছে প্রাণহানি

সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরা, কামরাঙ্গীরচর, পল্লবীতে ছিনতাইয়ের সময় বাধা দেওয়ায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে ঘটেছে মৃত্যুর ঘটনা। ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া মানুষের আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। তবে আহতদের অনেকেই আইনি ঝামেলায় পড়তে চান না, ফলে পুলিশের কাছেও যান না। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে যান। এদিকে অভিযোগ উঠেছে, ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশি টহল বাড়ানো হলেও কমছে না এসব ঘটনা। যদিও পুলিশ বলছে, চুরি কিংবা ছিনতাই ঠেকাতে কাজ করছেন তারা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ছিনতাই হচ্ছে। পথচারী বা সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন, টাকা-পয়সাসহ সবকিছু ছিনিয়ে নিচ্ছে ছিনতাইকারীরা। বাধা দিতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে ছিনতাইকারীদের ধস্তাধস্তির ঘটনাও ঘটছে। এসময় ছিনতাইকারীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হচ্ছেন ভিকটিমরা। গুরুতর জখম থেকে মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে।  

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকাসক্তির কারণে চুরি-ছিনতাই যেমন বেড়ে যায়, ঠিক তেমনি এসব ঘটনা ঘটাতে গিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতেও দ্বিধাবোধ করছে না ছিনতাইকারীরা।

গোয়েন্দারা বলছেন, ছিনতাইয়ে জড়িত অনেকেই মাদকাসক্ত। তারা মাদকের টাকার জন্য জড়িয়ে যায় ছিনতাইয়ে। যতক্ষণ পর্যন্ত টাকা সংগ্রহ না হচ্ছে এবং মাদক নিতে না পারছে ততক্ষণ কোনও শান্তি নেই। এই সময় মাদকাসক্ত ছিনতাইকারীরা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ছিনিয়ে নেওয়ার সময় বাধা পেলেই উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতের শিকার হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। যা অনেকটাই উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

গত ১১ সেপ্টেম্বর ভোরে কামরাঙ্গীরচরের কয়লারঘাট সুরুজবাগে একটি ব্যাগের কারখানার হৃদয় (১৭) নামের এক শ্রমিক নাইট ডিউটি করছিল। ভোরে সে খাবার খেতে যায় পাশের একটি হোটেলে। যাওয়ার সময় ২/৩ ছিনতাইকারী তার গতিরোধ করে। তার সঙ্গে থাকা মোবাইল ও টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় ছিনতাইকারীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। তখন ছিনতাইকারীরা হৃদয়কে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৭ সেপ্টেম্বর ভোর রাতে ঢাকা মেডিক্যালে হৃদয় মারা যায়।

এ ঘটনায় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই জনকে গ্রেফতার করেছে কামরাঙ্গীরচর থানা পুলিশ। পরে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ছিনতাইকালে ভুক্তভোগীর সঙ্গে টানাহেঁচড়া করার সময় ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় তারা। এ ঘটনায় আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছে ছিনতাইকারীরা।

টঙ্গী থেকে উত্তরা আসার সময় রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর ব্রিজ এলাকায় গত ৬ জুলাই ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সাঈদ (১৭)। মোবাইল ও টাকা ছিনতাইয়ের সময় বাধা দেওয়ায় তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে তার মৃত্যু হয়।

রাজধানীর মিরপুর পল্লবীতে গত ২৯ জুলাই এক রিকশাচালকের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ ধারণা করছে, তার রিকশাটি ছিনিয়ে নিতেই ছিনতাইকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলায় আঘাত করে। পরে রিকশাটি নিয়ে পালিয়ে যায় তারা। তবে ভুক্তভোগী রিকশাচালকের মৃত্যু হয়।

গত ১১ আগস্ট রাতে উত্তরায় একটি ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলার সময় বুথের ভেতরে ছিনতাইকারীর  ছুরিকাঘাতে নিহত হন ব্যবসায়ী শরিফ উল্লাহ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভুক্তভোগী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমি বিমানবন্দর থেকে প্রাইভেটকারে আসার সময় মালিবাগে চাকা পাংচার যায়। তখন আনুমানিক ভোর সাড়ে ৪টা। চাকা পরিবর্তন করার সময় হঠাৎ তিন চার জন এসে আমাকে ঘিরে ফেলে। আমার সঙ্গে থাকা মোবাইল ও টাকা ছিনিয়ে নেয়। গাড়ির চাবি নেওয়ার সময় ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে চিৎকার করলে আমার হাতে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে আমি হাসপাতালে চিকিৎসা নিই। কিন্তু থানায় এ ব্যাপারে কোনও মামলা করিনি। আর কোনও ঝামেলায় পড়তে চাইনি। এখনও এটা নিয়ে আতঙ্কিত থাকি আমি।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) এ কে এম হাফিজ আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রতিরোধে থানা পুলিশ কাজ করছে। থানা এলাকাগুলোয় নিয়মিত টহল দেওয়া হচ্ছে। ছিনতাইয়ের প্রবণতা রাতে এবং ভোরবেলা বেশি দেখা যায় রাস্তা খালি থাকার কারণে। এছাড়া ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রতিরোধে থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দারাও কাজ করছে। যেকোনও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলে বা তাদের কবলে পড়লে সেটি সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনায় গেলো কয়েক মাসে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩০০-এর অধিক ছিনতাইকারীকে আমরা গ্রেফতার করেছি। ছিনতাই যেন না ঘটে সে ব্যাপারে আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি। গোয়েন্দা তৎপরতাও রয়েছে।

অ্যাথেনা মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্রের মেন্টাল হেলথ কাউন্সেলর নুসরাত সাবরিন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মাদকাসক্তির সঙ্গে অপরাধের একটি বড় যোগসূত্র রয়েছে। মাদকাসক্তি এক ধরনের মানসিক রোগ। মাদকের প্রতি নির্ভরশীলতা তৈরি হওয়ার কারণে ব্যক্তির স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি থাকে না, বরং মাদকই তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। যখন তার মাদকের প্রয়োজন পড়ে, তখন সে টাকার জন্য চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। সমাজ থেকে মাদকাসক্তি দূর করতে মাদক প্রতিরোধমূলক নানা তৎপরতার পাশাপাশি পরিবারের ভূমিকা ও সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারে একজন সদস্য মাদকাসক্ত হলে এটা লুকিয়ে না রেখে বা বিকল্প পদ্ধতি না খুঁজে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার আওতায় আনা হলে অনেক সমস্যাই প্রতিরোধ করা সম্ভব।