সেপ্টেম্বরে সড়কে নিহত ৪৭৬ জন

সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশে ৪০৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৭৬ জন এবং আহত ৭৯৪ জন। এর মধ্যে ১৮২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১৬৯ জন, যা মোট নিহতের ৩৫.৫০ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৪.৭১ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১০৩ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২১.৬৩ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৬৩ জন, অর্থাৎ ১৩.২৩ শতাংশ। নিহতের মধ্যে নারী ৬২ ও শিশু ৭৭।

সোমবার (৩ অক্টোবর) রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, গত সেপ্টেম্বর মাসে ৯টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৭৮ জন নিহত হন এবং ৩ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ২১টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত এবং ৬ জন আহত হয়েছেন।

৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনে দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের এই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ১৬৯ জন (৩৫.৫০%), বাস যাত্রী ৩৬ জন (৭.৫৬%), ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি আরোহী ২৮ জন (৫.৮৮%), মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার আরোহী ৯ জন (১.৮৯%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা) ১০৪ জন (২১.৮৪%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-করিমন-আলমসাধু-পাখিভ্যান-মাহিন্দ্র-টমটম) ১৩ জন (২.৭৩%) এবং বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা আরোহী ১৪ জন (২.৯৪%) নিহত হয়েছেন।

দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৩৪টি (৩২.৯২%) জাতীয় মহাসড়কে, ১৫৮টি (৩৮.৮২%) আঞ্চলিক সড়কে, ৭৩টি (১৭.৯৩%) গ্রামীণ সড়কে এবং ৩৬টি (৮.৮৪%) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৬টি (১.৪৭%) সংঘটিত হয়েছে।

দুর্ঘটনার ধরন

দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৬৬টি (১৬.২১%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৮৭টি (৪৫.৯৪%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১০৫টি (২৫.৭৯%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেওয়া, ৪১টি (১০.০৭%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ৮টি (১.৯৬%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।

দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ

সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে ভোরে ৩.৯৩%, সকালে ২৬.৫৩%, দুপুরে ২১.৬২%, বিকালে ১৭.১৯%, সন্ধ্যায় ৭.৩৭% এবং রাতে ২৩.৩৪%। রাজধানী ঢাকায় ২৯টি দুর্ঘটনায় ২৩ জন নিহত ও ৩৭ জন আহত হয়েছেন।

দুর্ঘটনার কারণ

দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে- ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; বেপরোয়া গতি; চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি; গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।

সুপারিশ

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সুপারিশগুলো হলো- দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বাড়াতে হবে; চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; বিআরটিএ’র সক্ষমতা বাড়াতে হবে; পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্ব রাস্তা (সার্ভিস রোড) তৈরি করতে হবে; পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমাতে হবে; টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে; ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

দুর্ঘটনা পর্যালোচনা ও মন্তব্য

সড়ক দুর্ঘটনায় গত আগস্ট মাসে ৫১৯ জন নিহত হয়েছিলেন। গড়ে প্রতিদিন নিহত হয়েছিলেন ১৬.৭৪ জন। সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিদিন গড়ে নিহত ১৫.৮৬ জন। এই হিসাবে সেপ্টেম্বর মাসে প্রাণহানি কমেছে ৫.২৫%। তবে প্রাণহানি হ্রাসের এই মাত্রা কোনও টেকসই উন্নতির সূচক নির্দেশ করছে না।

দুর্ঘটনায় দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৬২ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। শিক্ষক নিহত হয়েছেন ১৪ জন। দুর্ঘটনায় ১৯ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৩৮৪ জন, অর্থাৎ ৮০.৬৭ শতাংশ।

রেল ট্র্যাকে দুর্ঘটনা বাড়ছে। ট্রাক-সহ পণ্যবাহী দ্রুতগতির যানবাহন ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাও কমছে না। মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ড্রাইভারদের বেপরোয়া গতিতে পণ্যবাহী যানবাহন চালানো এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যান্য যানবাহনকে আক্রান্ত করছে। গণপরিবহন সহজ, সাশ্রয়ী ও উন্নত করে, যানজট কমিয়ে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করা জরুরি।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যস্থাপনার কারণে। এই অবস্থার উন্নয়নে টেকসই সড়ক পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।