দালালেরও কিছু নীতি থাকে

যমুনা ফিউচার পার্কে অবস্থিত ভারতীয় ভিসা সেন্টারে দীর্ঘ লাইন। নিয়ম মেনে এগিয়ে এক ঘণ্টায়ও মূল গেটে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। লাইন হাঁটছে কিন্তু আপনি যেখানে ছিলেন, সেখানেই থাকছেন। মিনিট ত্রিশ পরে লাইন ভেঙে সামনে এগিয়ে গেলেন দেখার জন্য, ‘কাহিনি কী!’

দেখা যাচ্ছে, প্রধান লাইনের সামনের দিকের অংশে সিরিয়াল ভেঙে লোক ঢোকানোর জন্য দুটি দরজা ব্যবহার করা হচ্ছে। একটি হলো ক্যাফের দরজা, যেটির ভেতরের গেট ঠিক ভিসা সেন্টারের দরজা থেকে ৫০০ গজ দূরে; আরেকটি হলো তার একটু পেছনে। এই দুই গেট দিয়ে ঢুকলে আপনি সর্বোচ্চ ১০ জনের পেছনে থাকবেন। কিন্তু কীভাবে?

ভিসা সেন্টারের কাছাকাছি পৌঁছাতেই আপনার পাশ দিয়ে লোক যেতে থাকবে অফার দিয়ে। পাশে আপনার কাছের মানুষের মতোই হাসিমুখে হাঁটবে আর বলবে, ‌‘হেল্প লাগবে?’ কিংবা বলবে, ‘পাঁচ মিনিটেই সব কমপ্লিট।’ কিংবা বলবে, ‘সবার আগে কাজ করে বের করে দেবো।’

সেই অফারের বিষয়ে জানতে আগ্রহী হলে তারা বলবে, ‘এক ফাইল এক হাজার।’ একটু দেনদরবার করলে এক ফাইল ৪০০ টাকায় সম্ভব। আপনি ভেবেছেন, ৪০০ টাকা দিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব করে বের হবেন। আর দালাল আপনাকে সেই গেট দুটির একটিতে নিয়ে গিয়ে গেটম্যানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চোখে চোখে কথা বলে পগারপার।

গেট দিয়ে আপনি ঠিকই ঢুকে গেলেন, কিন্তু মূল লাইনে সিরিয়াল ভেঙে ঢুকবেন কীভাবে? যারা লম্বা সময় অপেক্ষ করে এই শেষ ধাপে এসেছেন, তারা কেন আপনাকে লাইনে ঢুকতে দেবেন? তখন না পাবেন সেই ৪০০ টাকার দালালকে, না আপনাকে চিনবে সেই গেটম্যান। এই লম্বা লাইনটি যে কক্ষে ঢুকবে, সেটার নিরাপত্তাকর্মী আপনাকে ধমক দিয়ে আবারও শেষ মাথায় পাঠিয়ে দেবে। অর্থাৎ ৪০০ টাকা গচ্চা দিয়ে আরও কমপক্ষে ৩০ জনের পেছনে দাঁড়াতে বাধ্য হবেন।

এমনই এক পরিস্থিতির শিকার মাইমুনা বলেন, ‘আমি অসুস্থ মানুষ। এসে দেখি সিস্টেম করে অনেকেই ঢুকছে। আমি একজনকে ৬০০ টাকা দিয়ে সামনের দিকের এই ক্যাফে গেট দিয়ে ঢুকেছি, কিন্তু লাইনে ঢুকতে পারছি না। কেউ একটু জায়গা দিচ্ছে না। তাহলে এইটা কোন রকমের দালাল হলো?’

দালাল নয়, নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে

ঢাকা বা ঢাকার বাইরে থেকে যারা ভিসা নিতে আসেন, আগে কখনও ভারতে যাননি, তারা দালালের খপ্পরে বেশি পড়েন। কেননা, তারা জানেন না পুরো প্রক্রিয়াটি কী। সেন্টারের ভেতরে ৪০টির বেশি বুথ রয়েছে। যতই ভিড় থাকুক, আধাঘণ্টা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলে আপনি লাইন ধরেই সেন্টারে প্রবেশ করতে পারবেন। দালালের মাধ্যমে আপনি শুধু সিরিয়াল ভেঙে লাইনে জায়গা করতে পারবেন। ভেতরে ঢুকে আবেদন জমা দিয়ে, বায়োমেট্রিক করিয়ে আপনাকেই বের হতে হবে। যদি কোনও সহায়তা দরকার হয়, তবে ভেতরেই হেল্পডেস্ক আছে, যদি কোনও কাগজ ফটোকপি করার দরকার হয়, লাইন ধরে সেটিও করতে পারবেন।

যদি একটু চা-পানি খেতে চান, সে জন্যও সেই কক্ষেই আছে একটি ছোট বুথ। সব কাজই আপনাকে একা করতে হবে। কেবল বিষয়টি না জানার জন্য ‘সব করে দেবো সবার আগে, পাঁচ মিনিটে’ বলে দালালগুলো যার কাছে যা পারছে নিয়ে যাচ্ছে।

গেটম্যানদের অনেকেই জড়িত

সেন্টারে দালালরা যে ‍দুই পথ দিয়ে প্রবেশ করাচ্ছে আবেদনকারীদের, সেখানে কয়েক দফা হট্টগোল চোখে পড়ে। একজনকে প্রবেশ করানোর পর টাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব হয় গেটম্যানের সঙ্গে দালালের। সে আর তার কোনও লোক না ঢোকানোর কথা বললে সেই দালাল পাল্টা বলে, ‘ভেতরে যারা গেছে, তাদেরও বের করে দেন।’

কী হয়েছে জানতে চাইলে এক দালাল নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের জনপ্রতি একটা অ্যামাউন্ট দিতে হয়। সেটা একটু কম নিতে বলায় ঝামেলা হয়েছে। এ রকম হয়। কেন প্রশ্ন করছি জিজ্ঞেস করে তিনি বলেন, ‘আপনারা কিছু লিখলে আপনার ভিসা হবে না।’

সেন্টারের মূল কক্ষে নিয়মতান্ত্রিক কাজ

সেন্টারের মূল কক্ষে প্রবেশমুখেই আপনার কাছে জানতে চাইবে ভিসা কোন ধরনের। মেডিক্যাল, ট্যুরিস্ট, বিজনেস, বিদেশি নাগরিক—যা-ই বলবেন, সে অনুযায়ী আপনার সিরিয়াল পড়বে এবং সেখানে একাধিক ডিসপ্লেতে দেখাবে কোন ক্যাটাগরির কোন সিরিয়াল কোন বুথে চলছে। আপনি যেন প্রক্রিয়া বুঝতে পারেন, সে জন্য কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী আছেন। তারা সেটি ঠিকমতো বুঝিয়ে দেন। মোট ৪৪টি বুথে কাজ হওয়ায় একজনের পেছনেও যদি আপনার সিরিয়াল থাকে, তাহলে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের বেশি লাগবে না।

দেশের বাইরে যাবেন পঞ্চাশোর্ধ্ব সারোয়ার জাহান। এসব অনিয়মের বিষয়ে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের ধৈর্য কম। এরা অনেক ভালো নিয়ম করে রেখেছে। আমরা আগে যাওয়ার জন্য টাকা দিচ্ছি, সেটাই তো নৈতিক না। তাহলে দালাল তাকে ঠকালো, সেটা নিয়ে কথা বলার জায়গা থাকে? সকাল ১০টায় এসে দুপুর ১২টাতেও কাজ শেষ করতে পারিনি। এর জন্য তো সেন্টার দায়ী না। সব নিয়ম মতো চলতে থাকলে এত সময় লাগতো না।’