ভোক্তার ভ্যাটকে নিজেদের রাজস্ব বলে দাবি করে তামাক কোম্পানিগুলোর

বাংলাদেশের তামাক কোম্পানিগুলো, বিশেষ করে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি সরকারকে সর্বোচ্চ পরিমাণ ট্যাক্স দেওয়ার তথ্য দিয়ে এলেও বাস্তবে তামাক খাতের রাজস্বের ৯৪ শতাংশেরও বেশি আসে জনগণের ভ্যাট থেকে। অর্থাৎ বহুদিন ধরে ভোক্তাদের প্রদত্ত ভ্যাটকেও তামাক কোম্পানি তাদের প্রদত্ত রাজস্ব বলে চালিয়ে আসছে।

বুধবার (১৬ নভেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‌‘তামাক কোম্পানির বহুল প্রচারিত রাজস্ব মিথ এবং তুলনামূলক বিশ্লেষণ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের চিকিৎসক ডা. মাহবুব সোবহান লিখিত বক্তব্যে এসব কথা বলেন।

বাংলাদেশ তামাকবিরোধী জোট, বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি ও ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের যৌথ উদ্যোগে এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজিত হয়।

ডা. মাহবুব সোবহান বলেন, বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত আইন ভঙ্গ করে তামাক ব্যবহার বৃদ্ধি, কর ফাঁকিসহ নানা অপচেষ্টা যাচ্ছে। প্রতিবছর খুব পরিমাণে কর বাড়লেও প্রচলিত কর কাঠামোর ত্রুটির কারণে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়মূল্য আদতে ভোক্তার নাগালের মধ্যেই থেকে যাচ্ছে। অথচ কর ও মূল্যবৃদ্ধি তামাক নিয়ন্ত্রণে সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হিসেবে বিবেচিত।

শুধু কর বৃদ্ধির ফলেই ২০০৭-১০ এই তিন বছরে ইউরোপের ৪১টি দেশের ৩৫ লক্ষাধিক মানুষকে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা থেকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে।

তামাক ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট জনস্বাস্থ্য ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু তামাকজাত দ্রব্যের কর বৃদ্ধিতে তেমন আশানুরূপ কোনও পরিবর্তন আসেনি।

সিগারেটের খুচরা বিক্রি বন্ধ ও দাম বাড়ালে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমে যাবে ও সরকারের আয় বাড়বে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সিগারেটের প্যাকেটে মুদ্রিত খুচরা মূল্যের আগে বা পরে সর্বোচ্চ-সর্বনিম্ন শব্দটি উল্লেখিত না থাকায় এবং খুচরা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রির সুযোগ নিয়ে স্থানভেদে পণ্যের মোড়কে মুদ্রিত মূল্যের থেকে অধিক মূল্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি হচ্ছে। এই অতিরিক্ত মূল্যের ওপর কোনও প্রকার কর ধার্য না হওয়ায় কারণে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে মূলত দুটি বিদেশি কোম্পানি দেশের তামাক ব্যবসার সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করেছে। তারা এ দেশ থেকে শুধু লভাংশই নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দায়বিহীনভাবে রেখে যাচ্ছে তামাকের ফলে সৃষ্ট রোগ, রোগাক্রান্ত ব্যক্তি এবং অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক ক্ষতি।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০১৮ সালে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর তামাক খাত থেকে সরকারের উপার্জিত রাজস্বের বিপরীতে তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা বাবদ সরকারের ব্যয় হয় ৭ দশমিক ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।’

বিগত বছরগুলোয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে তামাকের মূল্যবৃদ্ধি না হওয়ার পেছনে তামাকজাত পণ্যের ওপর প্রচলিত কর কাঠামোর দুর্বলতা এবং কার্যকর ও শক্তিশালী কর-নীতি না থাকা প্রধান কারণ বলে বিবেচিত বলেও মন্তব্য করেন মাহবুব সোবহান।

তামাক সমস্যা সমাধানে আয়োজক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে কয়েকটি সুপারিশ দেওয়া হয়। এগুলো হলো তামাকের ওপর সুনির্দিষ্ট কর কাঠামো প্রণয়ন; তামাক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ও শক্তিশালী কর-নীতি প্রণয়ন; তামাকের ওপরে নির্ভরশীলতা কমিয়ে কর আদায়ের অন্যান্য শক্তিশালী মাধ্যম খুঁজে বের করা; ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সব ধরনের তামাকজাত পণ্যের ভিত্তিমূল্য ও কর বৃদ্ধি করা; মূল্যস্তরের সংখ্যা ৪টি থেকে কমিয়ে ২টি করা; স্বাস্থ্যক্ষতি ও স্বাস্থ্য ব্যয় বিবেচনায় রেখে কর কাঠামো পুনর্গঠন করা; খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধকরণসহ সব ধরনের ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্য ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে রেজিস্ট্রেশন ও করের আওতায় আনা।

বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন দ্য ইউনিয়নের কনসালট্যান্ট ফাহিমুল ইসলাম, ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের কান্ট্রি ম্যানেজার মো. নাসির উদ্দিন শেখ, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারী ও কর্মসূচি প্রধান সৈয়দা অনন্যা রহমান প্রমুখ।