সারাদেশ থেকে বীরাঙ্গনাদের যেসব দাবি জনসম্মুখে

বীরাঙ্গনা জেলেখা এইবছর আগস্টে মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি কেবল স্বীকৃতি চেয়েছিলেন, পাননি। নিরক্ষর এই নারীর জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির সময় জন্মসাল অনুমানে লিখে দিয়েছিল কেউ। আর এতেই বিপত্তি। সেই পরিচয়পত্র অনুযায়ী জেলেখার বয়স ‍যুদ্ধকালে আট বছর হয়। বারবার অনুরোধ করেও তিনি বুঝাতে পারেননি এই বয়স তিনি নির্ধারণ করেননি। স্বীকৃতি ছাড়া এই পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়েছে তাকে।বিভিন্ন স্থান থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়ে আলোচনায় অংশ নেন বীরাঙ্গনারা

যেসব বীরাঙ্গনা এখনও স্বীকৃতি পাননি তাদের জীবনবাস্তবতা ও দাবি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন অনলাইনে। নারীপক্ষের আয়োজনে ‘সংঘাতকালীন যৌন সহিংসতা: ক্ষতিপূরণ ও প্রতিকার’ বিষয়ে আলোচনায় ৩০ জন বীরাঙ্গনা দাবি নিয়ে হাজির হন। তাদের দাবি, তারা বীরাঙ্গনা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে চান।

বৃহস্পতিবার (২৪ নভেম্বর) নারীপক্ষের অফিসে দিনব্যাপী এই আলোচনায় অংশ নিয়ে বীরাঙ্গনারা তাদের কথা বলেন।image2

শুরুতে নারীপক্ষের সদস্য শিরিন হক বলেন, যেটা করতে পারা উচিত ছিল সেটা আমরা করতে পারিনি। ২০১১ সাল থেকে ছোট পরিসরে শুরু করি। বর্তমানে ৪৮ জন নারী যারা রাষ্ট্রীয় তালিকাভুক্ত হতে পারেননি তাদের আমরা কিছু অনুদান দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু সেটা কিছুই না।

রাজশাহী চারঘাট থানাপাড়ার সপুরা অনলাইনে এসে বলেন, আমরা সবসময় দেখি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কত আয়োজন। আমরা কী কিছুই অবদান রাখিনি। আমাদের খোঁজ কেউ নেয় না কেন। অধিকার চাইতে গেলে এখনও দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। আমরা মুক্তিযোদ্ধার কার্ড তাড়াতাড়ি চাই। মাথা উঁচু করে যেতে চাই। সারাজীবন লজ্জা নিয়েই কাটলো।

তালিকাভুক্ত হতে ঘুসের অভিযোগ করলেন অনেকে। তাদের প্রশ্ন, পাশের জন তালিকায় উঠতে পারলে আমি পারলাম না কেন। আমার নাম উঠাতে যে টাকা চায়—তা আমি কোথা থেকে দেবো? যুদ্ধের পর সবাই একঘরে করে রেখেছে। আমার জীবনে রাষ্ট্রও যদি সম্মান ফিরিয়ে না দেয় তাহলে দেশের স্বাধীনতার মূল্য কী? আমার দিন তো শেষ। আগামী দিনে আমার পরিবারের সদস্যরা যেনও সম্মান নিয়ে টিকে থাকে সেইজন্য আমার স্বীকৃতি দরকার।

কুড়িগ্রামের আবিরুন এখন নানা দাবি নিয়ে অনেকটাই ক্লান্ত। তিনি বলেন, আমি কত আবেদন করতে গেছি। একমাত্র আমি, আমরা বীরাঙ্গনারা বাদে সবার জীবন সুন্দর চলছে, আমাদেরকে যেন কেউ চোখেই দেখে না। আমি ডিসি-ইউএনও কোথায় যাই নাই! কোনও লাভ হয়নি। আমরা স্বীকৃতি চাই।image0

স্তব্ধ হয়ে যেতে হয় যখন ময়মনসিংহের পয়রবি বলেন, কিছু টাকা অনুদান পাই, সম্মান তো পাই না। ভাতা চাইতে হবে কেন? সারাজীবন শারীরিক-মানসিক ক্ষত নিয়েই পার করলাম। আমাকে এখনও ওইসব সময়ের কথা, গালি শুনতে হয়।

নারীপক্ষের এই আলোচনার মধ্য দিয়ে যেসব করণীয় বেরিয়ে আসে সেগুলো হলো—এলাকায় বীরাঙ্গনা নারীদের জন্য স্মৃতিসৌধ, রাস্তা এবং পার্কের নাম করতে হবে, স্বাধীনতা ও বিজয়ের মতো জাতীয় উদযাপনে বীরাঙ্গনাদের অন্তর্ভুক্ত করে সামনে আনতে হবে। তাদের কণ্ঠস্বর, গল্প, জীবন অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করে রাখা—যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ইতিহাসের এইদিক সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। জাতীয় গণমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে তাদের দাবি প্রচার করতে হবে।