প্রণোদনা সত্ত্বেও রেমিট্যান্স বাড়ছে না: সংসদীয় কমিটি

সরকারের তরফ থেকে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া সত্ত্বেও প্রত্যাশিত হারে রেমিট্যান্স বাড়ছে না। প্রবাসী কর্মীদের কর্মস্থল থেকে ব্যাংকগুলোর দূরত্ব বেশি এবং হুন্ডি ব্যবসায়ীদের থেকে নানা ধরনের সুবিধা পাওয়ার কারণেই প্রবাসী কর্মীরা এখনও হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠাতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

বুধবার (৭ ডিসেম্বর) সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকের আলোচনায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। বৈঠকে কমিটির আমন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরাও অংশ নেন।

পরে কমিটির পক্ষ থেকে হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ইনসেনটিভসহ প্রবাসীদের অন্যান্য সুবিধা প্রদানে একটি প্রস্তাবনা বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়।

জানা গেছে, কমিটির আগের বৈঠকে রেমিট্যান্স প্রবাহ না বাড়ার কারণ নিয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ, ব্যাংক রেট ও হুন্ডির রেটের ব্যাপক ব্যবধানের কারণে বৈধপথে টাকা আসার পরিমাণ কমে গেছে।’ বৈঠকে কমিটির সভাপতি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ  প্রণোদনা ২.৫ শতাংশের স্থলে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেন। ওই বৈঠকের সুপারিশ অনুযায়ী, বুধবারের বৈঠকে হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ এবং রেমিট্যান্স বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি চ্যানেলে টাকা পাঠানোর সুবিধার জন্য প্রবাসীদের ইনসেনটিভসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদানের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা হয়।

জানা গেছে, বৈঠকে বৈধ চ্যানেলে টাকা কম আসার কারণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়— ব্যাংকগুলো প্রবাসী কর্মীদের কর্মস্থল থেকে অনেক দূরে হাওয়ায় তারা সময় ও টাকা খরচ করে ব্যাংকে গিয়ে টাকা পাঠাতে আগ্রহ কম দেখায়। অপরদিকে হুন্ডির সঙ্গে যারা জড়িত, তারা উল্টো প্রবাসী কর্মীদের বাসা বা কর্মস্থলে গিয়ে নিজেরাই অর্থ সংগ্রহ করে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে মাসের বেতন না হওয়ার আগেই নিজেদের থেকে টাকা পাঠিয়ে দেয়। পরে বেতন পেলে কর্মীরা তাদের পরিশোধ করেন। হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো তাদের জন্য ‘সহজ’ হওয়ায় তারা বৈধ চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাতে বেশি আগ্রহী থাকেন। বাংলাদেশি কর্মীরা কাজ করেন—এমন অনেক দেশের দোকানে দোকানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের (বাংলাদেশি) আড়ালে হুন্ডি ব্যবসা করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়।

বিস্তারিত আলোচনার পর কমিটির পক্ষ থেকে হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ এবং রেমিট্যান্স বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি চ্যানেলে টাকা পাঠানোর সুবিধার জন্য প্রবাসীদের ইনসেনটিভসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদানের বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের জন্য কমিটি মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়—বৈঠকে প্রবাসীদের বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর জন্য উৎসাহিতকরণ এবং তাদের কর্মস্থলের কাছাকাছি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কোনও মানি এক্সচেঞ্জ স্থাপন করা যায় কিনা, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। এছাড়া, মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীদের নিকট থেকে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির টাকা গ্রহণের পরিমাণ কমানোর যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

বৈঠকের কার্যপত্র থেকে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে সত্তর থেকে ৯০ হাজার কর্মী বিদেশে গেছেন বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে ৭৩ হাজার ৯৭১ জন, আগস্টে ৯১ হাজার ৩৮৮ জন, সেপ্টেম্বরে ৮৮ হাজার ৩০৪ জন, অক্টোবরে ৭৫ হাজার ২ জন এবং নভেম্বরে (২৪ নভেম্বর পর্যন্ত) ৬৩ হাজার ৬০৬ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। এদিকে সরকারি রিক্রুটিং এজেন্সি বোয়েসেলের মাধ্যমে জুলাই মাসে এক হাজার ২১৯ জন, আগস্ট মাসে এক হাজার ৪৫৯ জন, সেপ্টেম্বর মাসে এক হাজার ১৭৩ জন, অক্টোবর মাসে এক হাজার ১১৬ জন ও নভেম্বর মাসে এক হাজার ২৪৮ জন বৈদেশিক কর্মসংস্থানে নিয়োজিত হয়েছেন।

কমিটির আগের বৈঠকে মালয়েশিয়ার অভিবাসন ব্যয় ৩ লাখ ৮০ হাজার থেকে ৪ লাখ পর্যন্ত উল্লেখ করে বলা হয়, অভিবাসন ব্যয় অত্যধিক হওয়ার জন্য বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে খারাপ প্রভাব পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসন ব্যয় বাড়তে শুরু করবে। ওই বৈঠকে কমিটির সভাপতি বলেন, মালয়েশিয়া কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সি নির্বাচনে নির্দিষ্ট মানদণ্ড দরকার। কিন্তু সেটা না করে কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি করাপটেড পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে।

বুধবারের বৈঠকে মালয়েশিয়া কর্মসংস্থানের ধীরগতির কারণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে—মালয়েশিয়া হাইকমিশন থেকে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ১৩৬ জনের সত্যায়ন করা হয়ে থাকে। গত ২৪ জুলাই হরে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক লাখ ৩৫ হাজার ২২৯ জন কর্মীর সত্যায়ন করা হয়েছে। সত্যায়নের অপেক্ষায় আছে ২৬ হাজার ৫৯১ জন নিয়োগের সঙ্গে যুক্ত চাহিদাপত্র। রিক্রুটিং এজেন্টদের আবেদনের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ অনুমতি দেওয়া হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৩৬৯ জনের। বর্তমানে ১১টি আবেদনের বিপরীতে এক হাজার ৮১২ জনের নিয়োগ অনুমতি অপেক্ষায় আছে। ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএমইটি থেকে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়েছে ৩০ হাজার ৯৮৬ জনের। বিএমইটিতে কোনও অনিষ্পন্ন আবেদন নেই। ধারণা করা হয়—এজেন্ট এবং মালয়েশিয়া প্রান্তের কারণে মালয়েশিয়া কর্মী যাওয়ার ধীরগতির প্রধান কারণ।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, মৃণাল কান্তি দাস, পংকজ নাথ এবং হাবিবুর রহমান বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন।