কাগজের উচ্চমূল্য, বইমেলার ব্যস্ততার ছোঁয়া লাগেনি প্রেসপাড়ায়

অমর একুশে গ্রন্থমেলার মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকি। তবে প্রেসপাড়া হিসেবে খ্যাত দেশের সর্ববৃহত্ত প্রকাশনা ও বইয়ের ব্যবসাকেন্দ্র পুরান ঢাকার বাংলাবাজার এলাকায় তার বিন্দুমাত্র রেশ নেই। সময় এগিয়ে এলেও প্রকাশনা থেকে বাঁধাই— কারখানা কোথাও নেই ব্যস্ততার ছোঁয়া। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা দুষছেন কাগজের উচ্চমূল্যকে।

বাংলাবাজার এলাকার বাংলাবাজার রোড, প্যারিদাস লেন, শিরিষ দাস লেন, পাতলা খান লেন, রূপচান লেন, জয়চন্দ্র ঘোষ লেন ঘুরে দেখা যায়, প্রেসগুলোতে নেই বইমেলা উপলক্ষে নতুন বই ছাপানোর চাপ। গড়পড়তা ধর্মীয় বই, গাইড বই, চাকরির বই, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের বই ইত্যাদি ছাপানোর কাজ চলছে। বাঁধাই কারখানাগুলোরও একই হাল। বইমেলা উপলক্ষে নতুন বই বাঁধাইয়ের অর্ডার নেই তাদেরও।

প্রেস-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাগজের দাম বাড়ায় নতুন বই ছাপানোর আগ্রহ নেই প্রকাশনা সংস্থাগুলোর। অধিকাংশ সংস্থা এবারের বইমেলায় নতুন প্রকাশনার সংখ্যা কমিয়ে এনেছে ২০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। যার প্রভাব পড়ছে প্রেসগুলোতেও। বিশেষ করে ডিসেম্বর থেকেই কাজ শুরু হয় প্রেসগুলোতে, জানুয়ারি ও ডিসেম্বরে যার ব্যস্ততা তুঙ্গে পৌঁছায়।

সোলাইমান বুক বাইন্ডিং হাউসের স্বত্বাধিকারী মো. সোলাইমান বলেন, ‘এখনও কাজ আসা শুরু হয়নি। কাগজের দাম বাড়ার কারণে প্রকাশনা মালিকরা কাজ করাচ্ছেন না। অন্য বছর এই সময়টাতে অনেক কাজ থাকে, আমরা অর্ডার নিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারি না। কিন্তু এখন কাজ নেই। মোটামুটি সব প্রকাশনীই ২০ থেকে ৮০ শতাংশ কম বই আনবে বই মেলায়। সবাই ভয় পাচ্ছে, কাগজের দাম বেশি, বইয়ের দামও বাড়বে, যদি বিক্রি না হয়।’

মাহাবুব প্রিন্টসের ম্যানেজার শামীম হাসান বলেন, ‘কাজ এখনও নেই। আর ১০ থেকে ১৫ দিন পর অর্থাৎ মাসের শেষে কিছু কাজ আসবে আশা করছি। আমাদের তো একটা প্রত্যাশা থাকেই বইমেলার আগে কাজের চাপ থাকবে। তবে যদি বইমেলা শুরুর পর তেমন চাহিদা থাকে, তাহলে ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকেই চাপ তৈরি হবে।’

তবে অচলাবস্থায় বেশি বিপাকে বাঁধাই কারখানাগুলো, এমনটাই দাবি কারখানার মালিকদের। তারা বলছেন, প্রেসগুলোতে অন্য কাজ কম-বেশি থাকলেও বাঁধাই কারখানাগুলো বইমেলার ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। মূলত আগে এনসিটিবির বইয়ের কাজ এই এলাকায় এলেও বর্তমানে তা শতভাগ মাতুয়াইলকেন্দ্রিক। ফলে বইমেলার অপেক্ষায় ছিলেন এই এলাকার বাঁধাই কারখানার মালিকরা।

জিয়নপুর বুক বাইন্ডিং ওয়ার্কসের স্বত্বাধিকারী ইউসুফ আলী বলেন, ‘আমরা তো এনিসিটিবির কাজ পাই না। সব কাজ এখন মাতুয়াইলকেন্দ্রিক। আমরা অপেক্ষা করছিলাম বইমেলার আগে কাজ পাবো। কিন্তু প্রকাশনীগুলো অর্ডার দিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে কারখানাগুলো কর্মী ছাঁটাই করছে। আমার এখানে এই সময়টা আগে ২০ থেকে ৩০ জন কাজ করতো। এখন কাজ করাচ্ছি ৮ থেকে ১২ জন দিয়ে।’

পুস্তক বাঁধাই ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মাহাবুব আলম মল্লিক বলেন, ‘কাগজের দামের কারণে প্রকাশনীগুলো নতুন কাজ করছে না। ফলে বাঁধাই কারখানাগুলোতে কাজ নেই। এনসিটিবির বই কিছু ব্যবসায়ীর হাতে যাচ্ছে, আগে ৭০ শতাংশ কাজ আমরা বাংলাবাজার এলাকায় পেতাম। সবাই অপেক্ষা করছিল বইমেলার। এখন এই অবস্থায় প্রকাশনীগুলো বই না করলে আমাদের কাজ থাকবে না।’

প্রকাশনা সংস্থা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাগজের উচ্চমূল্যই বর্তমান অচলাবস্থার প্রধান প্রভাবক। কাগজ ও অন্যান্য সরঞ্জামের খরচ বাড়ায় স্বাভাবিক নিয়মে বাড়বে বইয়ের দাম। ফলে বই বিক্রির পরিমাণ নিয়ে সন্দিহান তারা।

দিব্য প্রকাশের মার্কেটিং ম্যানেজার সোহেল বলেন, ‘আমাদের এবার ১৫ থেকে ২০টা বই আসবে। গতবার নতুন প্রকাশনাই ছিল ৩০টি। কাগজের দামের কারণে এই অবস্থা। বিক্রি হবে কী হবে না, আমরা জানি না। এবার সেভাবে ব্যস্ততাও নেই, অন্য বছরগুলোতে প্রুফ রিডিং, কারেকশন প্রেস, বাঁধাইয়ের ব্যস্ততা চলে দিনরাত। আমাদের ৩টা বই তৈরি হয়ে গেছে বাকিগুলোরও কাজ চলছে। তারপরও আশা করছি পাঠকরা বই কিনবেন, বইমেলা সুন্দরভাবে হবে।’

কথা প্রকাশের সেলস ম্যানেজার জাফিরুল ইসলাম বলেন, ‘কথা প্রকাশ এবার ৭০ থেকে ৮০টা বই আনবে। কাগজের দাম বেড়েছে, তবে আমাদের যেহেতু ১২ মাস ব্যবসা, তাই খুব একটা প্রভাব পড়েনি। তবে অনেক প্রকাশনী বইয়ের পরিমাণ কমিয়ে আনছে গতবারের তুলনায়। তবে যেহেতু ১ তারিখেই এবার মেলা শুরু হচ্ছে, আশা করছি ভালো সংখ্যক বই বিক্রি হবে।’

অনিন্দ্য প্রকাশের প্রকাশক আফজাল হোসেন বলেন, ‘কাগজের যেভাবে দাম বেড়েছে, এই দামে বই বিক্রি করলে কেউ কিনবে না। গত বছর ১২৭ টা বই ছিল আমাদের, এবার ৩০টা। এবার আর নতুনদের সুযোগ দিতে পারিনি। আমাদের সৃজনশীল বইগুলো তো আর প্রয়োজনীয় না, জামা-কাপড়ের মতো যে মানুষ কিনবে। আমাদের এই সৃজনশীল বই শিল্প বাঁচাতে পাঠক ও সরকার দুপক্ষকেই মনোযোগী হতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকারিভাবে মাত্র পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও জাতীয় গ্রন্থাগারের মাধ্যমে। দেশে ৬৪ জেলা আর ৮ উপজেলায় পাঠাগার আছে মাত্র। সরকার যদি সব উপজেলায় পাঠাগার করে, তাহলে পাঁচশর অধিক পাঠাগার হবে। যেহেতু পাঠক পর্যায়ে সৃজনশীল বই কেনার প্রবণতা কম। এই পাঠাগারগুলোতে বই বিক্রি করে আমাদের শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম।’