একান্ত সাক্ষাৎকারে পাখি গবেষক মনিরুল হাসান খান

অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে কমে যাচ্ছে পাখিদের প্রাকৃতিক পরিবেশ

শীত এলেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) আঁকাবাঁকা লেকগুলোতে ভিড় জমায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পরিযায়ী পাখিরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এই পাখিরা এলেও দিনে দিনে তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও পাখি গবেষক ড. মোহাম্মদ মনিরুল হাসান খান মনে করেন, প্রাকৃতিক পরিবেশ পাখিদের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়া, দর্শনার্থীদের অতিরিক্ত ভিড় ও অসচেতনতা, সঠিক শৃঙ্খলা বজায় না রাখা, রাত্রিকালীন গোলযোগ এর অন্যতম কারণ।

তিনি একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলা ট্রিবিউনকে  বলেন, ‘পরিমাণে কম হলেও প্রতিবছরের মতো এবারও পাখি এসেছিল। তবে এবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে ঘিরে আতশবাজি ফোটানো, সাউন্ড সিস্টেমের অতিরিক্ত ব্যবহারের মতো রাত্রিকালীন ডিস্টার্বেন্স বেশি হয়েছে। এ ধরনের সমস্যাগুলো পাখির স্বাভাবিক পরিবেশের সঙ্গে যায় না। দিনের বেলার ডিস্টার্বেন্সে পাখিরা কিছুটা অভ্যস্ত হলেও রাতে তারা অভ্যস্ত নয়। পাখি না থাকার এটি অন্যতম একটি কারণ।’

ড. মনিরুল হাসান বলেন, ‘মানুষের কোলাহল নেই—এমন জায়গা পাখিরা পছন্দ করে। এজন্যই তারা মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকে ও বাসা বাঁধে। একই ধরনের আবাসস্থল যেমন সবার জন্য উপযুক্ত না। তেমনি পাখিদের জন্য কোলাহলমুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন।’

তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে পাখিদের প্রাকৃতিক পরিবেশ কমে যাচ্ছে। এটি পশু-পাখিদের জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের কথাও ভাবতে হবে। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশে পরিপূর্ণ জায়গাগুলোতে অবকাঠামো তৈরি না করে বিরানভূমিগুলো ব্যবহার করলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি কম হবে। এতে পশু-পাখিদের নিরাপদ পরিবেশও নষ্ট হবে না।’

ড. হাসান আরও বলেন, ‘অধিকাংশই শুধু লেকে আসা পাখিগুলোকে পরিযায়ী পাখি মনে করে। আসলে পরিযায়ী পাখিরা গাছপালা, ঝোপঝাড় সব জায়গাতেই আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলোতে যে পাখিগুলো আমরা দেখি, সেগুলো সত্তর দশকের শেষদিক, কিংবা আশির দশকের শুরু থেকে আসতে শুরু করেছে। প্রথম দিকে লেকগুলো নিচু জমি ছিল। পরবর্তীকালে খনন করায় পরিযায়ী পাখির পরিমাণ বাড়ে।’

তিনি বলেন, এযাবৎ ক্যাম্পাসে প্রায় সোয়া দুইশ’র মতো পাখির প্রজাতি পাওয়া গেছে। এর এক-তৃতীয়াংশ পরিযায়ী পাখি। পরিযায়ী বলতে অনেকে হাঁস জাতীয় পাখিগুলোকে মনে করে। এগুলো ছাড়াও ছোট বড় অনেক পাখি এখানে আসে। সরালি হাঁস স্থানীয় পরিযায়ী। এরা দেশের বাইরে থেকে আসে না। এটি হাঁস জাতীয় হলেও বাসা বাঁধে গাছে। খুব ঘন গাছের ভেতরে ও বড় গাছের কোটরে বাসা তৈরি করে। এ বছর নতুন কোনও প্রজাতির পাখি দেখা যায়নি।’

‘অতিথি পাখি নাকি পরিযায়ী পাখি’ এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মনিরুল হাসান বলেন, ‘ভ্রমণকারী পাখিদের পরিযায়ী বলা হয়। তারা অতিথি পাখি নয়। অতিথি মানে হলো বেড়াতে আসা। অতিথিরা ইচ্ছা হলে আসতে পারে, আবার নাও আসতে পারে। কিন্তু এই পাখিরা গ্রীষ্মকালে এক জায়গায়, আর শীতকালে আরেক জায়গায় কাটায়। শীত ও গ্রীষ্মপ্রধান উভয় দেশের বাসিন্দা এরা। তাদের জীবনযাপনের জন্য দুটো জায়গাই আবশ্যকীয়। ‘কনভেনশন অব মাইগ্রেশন স্পিচেস’ অনুযায়ী তারা যেখানে থাকে ও যেখান দিয়ে উড়ে যায়, তারা সেখানেরও বাসিন্দা। তাই অতিথি বললে মানুষের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছায়।’

তার মতে, পাখি ও প্রকৃতি একে অপরের পরিপূরক। পাখির ফেলে দেওয়া বীজ থেকে হয় গাছ। বিভিন্ন পোকামাকড় খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে পাখি। এজন্য পাখির আবাসস্থলগুলো রক্ষা করতে হবে। তাদের অনুকূল পরিবেশের জন্য ক্যাম্পাসের লেকগুলো খনন করতে হবে। যখন পরিযায়ী পাখিরা থাকে না, সেই মৌসুমে লেক ব্যবস্থাপনার কিছু উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সর্বোপরি প্রাকৃতিক পরিবেশ ঠিক রাখতে হবে। মানবসৃষ্ট ডিস্টার্বেন্স বন্ধ করার পাশাপাশি ভিজিটরদের নিয়ম-নীতির মধ্যে আনতে হবে।’