জেলা হাসপাতালে চিকিৎসকদের থাকার উপযোগী জায়গা নেই: গবেষণা

দেশের ৫২ দশমিক ৯ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের জন্য ব্যবহার উপযোগী ডরমেটরি বা কোয়ার্টার পাওয়া গেলেও জেলা হাসপাতালে এর পরিমাণ শূন্য বলে জানা গেছে এক গবেষণায়। গবেষণাটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্ট বিভাগ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে সম্পন্ন করা হয়েছে। সোমবার (২৩ জানুয়ারি) বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে ‘বাংলাদেশের জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে চিকিৎসকদের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গবেষণার তথ্য তুলে ধরা হয়। গবেষণাটি করেন বিএসএমএমইউ পাবলিক হেলথ ও ইনফোরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান।

গবেষকরা জানান, বাংলাদেশের জেলা হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে চিকিৎসকদের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে এই গবেষণা করা হয়। বাংলাদেশের ৯টি জেলা হাসপাতাল এবং ১৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সার্ভে চেকলিস্টের মাধ্যমে হাসপাতালগুলোর সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি ৭৭ জন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা/সিভিল সার্জন/সুপারিনটেনডেন্ট/ মেডিক্যাল অফিসার/আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য পর্যালোচনা করে গবেষণাটি করা হয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত এই গবেষণা পরিচালিত হয়।

গবেষণার তথ্য বলছে, শতভাগ জেলা হাসপাতালে রক্ত পরিসঞ্চালন সেবাটি থাকলেও ৪১ দশমিক ২ শতাংশ  উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এই সেবাটি পাওয়া যায়নি। জেলা হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যথাক্রমে ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ৪১ দশমিক ২ শতাংশ ক্ষেত্রে এক্স-রে পরিষেবা পাওয়া গেছে।

এছাড়া ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ জেলা হাসপাতাল এবং ৭৬ দশমিক ৫ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ইসিজি পরিষেবা পাওয়া গেছে।

৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ জেলা হাসপাতালে এবং ১১ দশমিক ৮ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আলট্রাসনোগ্রাম সুবিধা পাওয়া গেছে। ৭৭ দশমিক ৮ শতাংশ জেলা হাসপাতালে এবং ৬৪ দশমিক ৭ শতাংশ  উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মহিলা রোগীদের/অ্যাটেনডেন্টদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা পাওয়া যায়নি। শতভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের জন্য ডরমেটরি/কোয়ার্টার সুবিধা থাকলেও জেলা হাসপাতালে এর উপস্থিতি ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ।  ২০ শতাংশ জেলা হাসপাতালে এবং ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ  উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের জন্য থাকা ডরমেটরি/ কোয়ার্টারে গার্ড থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

অনুমোদিত পদের বিপরীতে শূন্য পদের চিত্র

জেলা হাসপাতালে ৩০ শতাংশ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬৩ শতাংশ আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারের পদ শূন্য রয়েছে। জেলা হাসপাতালে ৫১ শতাংশ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৭৭ শতাংশ জুনিয়র/সিনিয়র কনসালটেন্ট পদ শূন্য রয়েছে।

জেলা হাসপাতালে ৬৫ শতাংশ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩৮ শতাংশ মেডিক্যাল অফিসার/সহকারী সার্জন পদ শূন্য রয়েছে। নার্সিং স্টাফ/মিডওয়াইফ পদের ক্ষেত্রে জেলা হাসপাতালে ১৫ শতাংশ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৫ শতাংশ পদ শূন্য পাওয়া গেছে। জেলা হাসপাতালে ৫১ শতাংশ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪২ শতাংশ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট/ টেকনিশিয়ান পদ শূন্য পাওয়া গেছে। জেলা হাসপাতালে ২০ শতাংশ ক্লিনার পদ শূন্য থাকলেও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শূন্য ক্লিনার পদের পরিমাণ ৬৬ শতাংশ।

এছাড়া জেলা হাসপাতালে ৩১ শতাংশ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫৩ শতাংশ নিরাপত্তা প্রহরী বা আনসারের পদ শূন্য পাওয়া গেছে।

গবেষণায় তুকে ধরা চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে আছে, প্রয়োজনের তুলনায় কম, ছোট, পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ সেবাকক্ষ, অপরিচ্ছন্ন টয়লেট এবং নিরাপদ পানির অভাব, অনুপযুক্ত হসপিটাল বর্জ্য ব্যাবস্থাপনা, মেডিক্যাল অফিসার/ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান/ সহায়ক কর্মী সংকট, অতিরিক্ত কাজের চাপ, সঠিক চিকিৎসা প্রদানের জন্য স্বাস্থ্য সরঞ্জাম প্রযুক্তির অভাবকে অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিকিৎসকরা চিহ্নিত করেছেন।

এছাড়া কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতার অনাকাঙ্ক্ষিত চাপ ও প্রভাব, কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও কিছু স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীর অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সেবা প্রদানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়।

উচ্চশিক্ষা বা প্রশিক্ষণের সুযোগের অভাব, কর্মক্ষেত্রে বদলি বৈষম্য, অর্জিত জ্ঞান বাস্তবায়নে সুযোগের অভাব, বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসের মধ্যে বৈষম্য চিকিৎসকদের কর্মক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ।

জীর্ণশীর্ণ আবাসন ব্যবস্থা, শিশুদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা সুবিধার অভাব, দুর্বল যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের অবস্থানকে নিরুৎসাহিত করে।

সুপারিশ

মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সব স্তরের শূন্য পদ পূরণ করা প্রয়োজন।

অর্জিত দক্ষতা অনুযায়ী, চিকিৎসকদের যথাযথ পোস্টিং নিশ্চিত করা উচিত। পৃথক পরামর্শ কক্ষ, ওয়েটিং রুম, ডাক্তারের কক্ষ, চিকিৎসক ও রোগী উভয়ের জন্য পরিষ্কার টয়লেট সুবিধা, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশের উন্নতি করা প্রয়োজন।

প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, রসদ, প্রশিক্ষিত জনবল, ল্যাবরেটরি পরিষেবাগুলো উন্নত করা দরকার। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগীর অ্যাটেনডেন্ট, স্থানীয় প্রভাবশালী এবং স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি করতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। হাসপাতালের উপযুক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

চিকিৎসকদের জন্য মানসম্মত আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

পোস্টিং, বদলি এবং পদোন্নতির জন্য যুগোপযোগী নীতিমালা তৈরি এবং বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রয়োজনীয় সংশোধন করা এবং চিকিৎসকদের পূর্বশর্ত সম্পূর্ণ করার সঙ্গে সঙ্গে পছন্দসই বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার টিটু মিয়া।