মসজিদের পাশে ময়লাগার, পরিবেশ নিয়ে দুশ্চিন্তায় স্থানীয়রা

শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মসজিদ রাজধানীর ‘কামরাঙ্গীরচর ছাতা মসজিদ’। কামরাঙ্গীরচরের লোহার ব্রিজের দক্ষিণ-পূর্ব পাশেই এর অবস্থান। ১৯১২ সালের আগে উঁচু টিলার মতো ভূমির ওপরে ছোট আকারে চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত হয় মসজিদটি।

২০১০ সালের ২৯ অক্টোবর কামরাঙ্গীরচরের প্রথম মসজিদটি ভেঙে ছয়তলা ভিত্তি নিয়ে (১১ ফুট বাই ৫৫ ফুট আয়তন) নতুন করে মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয়। বর্তমানে নির্মাণাধীন মসজিদের নিচতলা ও দোতলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং তৃতীয় তলার কাছ চলমান আছে।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঐতিহ্যবাহী ছাতা মসজিদের পাশেই ময়লাগার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। মসজিদের পাশে ময়লাগার নির্মাণকে কেন্দ্র করে ক্ষোভ জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

জানা যায়, গত বছরের ২ অক্টোবর শুরু হয় মসজিদের পাশে ময়লাগার নির্মাণের কাজ। প্রথম দিকে সিটি করপোরেশনের অফিস হবে মর্মে সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করলেও পরে ময়লাগারের কথা শুনে এর প্রতিবাদ জানান স্থানীয়রা। পরে স্থানীয় কাউন্সিলরের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়।

কামরাঙ্গীরচরের স্থানীয় বাসিন্দা নূর উদ্দিন বলেন, ‘এই এলাকায় এমনিতেই যত্রতত্র ময়লা ফেলা হয়। চারপাশে ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে চলা দায়। মসজিদের আশপাশ মোটামুটি পরিষ্কার। এখন মসজিদের পাশে যদি ময়লাগার নির্মাণ করা হয়, তাহলে তো সেখান থেকে ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধ ছড়াবে। পরে দুর্গন্ধের কারণে মসজিদে বসে ঠিকমতো নামাজ পড়া যাবে না। সিটি করপোরেশনের এমন সিদ্ধান্ত অত্যন্ত গর্হিত। এখানে ময়লাগারের নির্মাণকাজ শুরুর আগেই আমরা মসজিদ কমিটিকে বিষয়টি অবহিত করেছি। তারা বলেছে, কমিশনারের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু এখনও এর কোনও বিহিত হয়নি। কাজ চলতেছে।’

কলেজছাত্র মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পুরো এলাকায় ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট কোনও স্থান নেই। এলাকার ময়লা-আবর্জনা রাখার জন্য একটা ময়লাগার দরকার। ময়লাগারটি পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সুবিধার জন্যই। তবে সেটা মসজিদের পাশে নয়। মসজিদের পাশে না হয়ে অন্য জায়গায় হলে ভালো হতো। কামরাঙ্গীরচরে তো অনেক সরকারি খালি জায়গা আছে, সেই জায়গাগুলোয় এই ময়লাগার নির্মাণ করলে ভালো হতো। তাহলে স্থানীয় মুরুব্বিদের মাঝে অসন্তোষ থাকতো না।’

স্থানীয় বাসিন্দা হাজী কালাম বলেন, ‘মসজিদের স্বার্থে, মসজিদের মুসল্লিদের স্বার্থে, মসজিদের সৌন্দর্য রক্ষার্থে এই ময়লাগার এখানে না হওয়া উত্তম। মসজিদ আমাদের ইবাদতের জায়গা। এলাকাবাসী মসজিদে আসেন নামাজ পড়ার জন্য। এখন মসজিদের পাশে যদি ময়লাগার নির্মাণ করা হয় বা ময়লা-আবর্জনার স্তূপ থাকে, তাহলে তো দুর্গন্ধ ছড়াবেই। এলাকার সবাই এর বিরোধিতা করলেও কোনও কাজ হয়নি। আমরা সবাই এখন নিরুপায়। এলাকাবাসী এর বিরুদ্ধে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করতে চেয়েছিল, সেটা আবার অন্যভাবে ঠেকানো হয়েছে। সিটি করপোরেশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তো আমাদের কিছু করার সুযোগ নেই।’

কামরাঙ্গীরচর ছাতা মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাজী ইসমাইল বলেন, ‘মসজিদের পাশে সিটি করপোরেশনের ময়লাগার নির্মাণের সিদ্ধান্তে মসজিদের মুসল্লিরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। আসলে মসজিদের পাশে যদি ময়লাগার থাকে, তাহলে তো সেখান থেকে দুর্গন্ধ ছড়াবেই। মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে সমস্যা হবে। এ নিয়ে কমিশনারের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। উনি বলেছেন, আমি চাই না মসজিদের কোনও ক্ষতি হোক বা মুসল্লিদের কোনও অসুবিধা হোক। উনি মসজিদের মুসল্লি ও আমাদের সমাজের অভিভাবক। তার এ কথার পর তো আমাদের আর কিছু বলার বা করার থাকে না।’

এ বিষয়ে ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘মসজিদ এবং ময়লাগার যেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে, দুটোই সরকারি জায়গা। সিটি করপোরেশন থেকে ময়লাগার নির্মাণ করার জন্য এই জায়গাটি নির্ধারিত করা হয়েছে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। তবে এটি একটি অত্যাধুনিক ময়লাগার। এখান থেকে বাইরে দুর্গন্ধ ছড়ানোর কোনও সুযোগ থাকবে না। এটা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে করা।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা শহরে কামরাঙ্গীরচরের এই ময়লাগারের মতো এমন তিনটি অত্যাধুনিক ময়লাগার নির্মাণ করা হবে। আসলে লোকজন এখন নানা ধরনের কথাবার্তা বলছে এটা সত্যি। কিন্তু যখন এটি সম্পূর্ণভাবে নির্মাণ হয়ে যাবে এবং মানুষ দেখবে এটা থেকে কোনও দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে না, তখন কেউ কিছু বলবে না।’

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এই ময়লাগার অত্যাধুনিক হবে। এই ময়লাগারে অনেক উঁচু চিমনি দেওয়া হবে, যার মাধ্যমে দুর্গন্ধ না ছড়িয়ে অনেক ওপরে চলে যাবে। ময়লাগারের সামনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে ফুলের গাছ লাগানো হবে। পরিবেশ রক্ষায় ও এলাকাবাসীর সুবিধার্থে এটি নির্মাণ করা হচ্ছে। বর্তমান মসজিদের আশপাশসহ এলাকায় চারপাশে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ হয়ে আছে। এখানে যদি ময়লা-আবর্জনার সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন তৈরি করা হয়, তাহলে আর পরিবেশ নষ্ট হবে না।

তিনি আরও বলেন, ‘ময়লাগারটি মসজিদ থেকে ৫০ গজের বেশি দূরে রাস্তার অপর পাশে নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বরং সবাই খুশি হওয়ার কথা। সেই জায়গায় এলাকাবাসীর ক্ষোভ বা অসন্তোষ একেবারেই অপ্রত্যাশিত। মানুষ ময়লা ফেলতে ফেলতে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল বন্ধ করে ফেলেছে। এখনও সবাই নির্দ্বিধায় বুড়িগঙ্গায় ময়লা-আবর্জনা ফেলছে। সর্বোপরি এই সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন কারও জন্য অসুবিধা হবে না। আমরা সবাই মুসলিম। আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে অসম্মান হবে, এমন কোনও কাজ আমরা করবো না। ধর্মীয় অনুভূতির নামে যারা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে, তারা এটা নিঃসন্দেহে ভুল করছে।’