স্থূলতা কেড়ে নিচ্ছে শৈশব: মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে নতুন প্রজন্ম

সাত পেরিয়ে আট বছরে পরবে সানিলা (ছদ্মনাম)। এই বয়সী একটা বাচ্চা মেয়ের ওজন সর্বোচ্চ থাকার কথা ২৭ কিংবা ২৮ কেজি। কিন্তু এ বয়সেই সানিলার ওজন ৪২ কেজি। এই বয়সে সানিলার যেখানে দুরন্ত গতিতে ছুটে বেড়ানোর কথা, চঞ্চল ফড়িংয়ের মতো নেচে বেড়ানোর কথা সেখানে সানিলা একেবারেই চুপচাপ। স্কুল টিফিনে বন্ধুরা যেখান খেলা শুরু করে দেয়, সানিলা তখন বসে বসে দেখে। হাঁটতে গেলে পড়ে যায়, দুই থেকে তিন কদম হাঁটলেই হাঁপিয়ে ওঠে, ওভারব্রিজে উঠতে গেলেই বসে পরে সিঁড়ির ওপরে, নিজের পোশাক নিজে পরতে পারে না। তাকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই পরিবারের সবার।স্থূলতা

সানিলার মায়ের অভিযোগ, সাধারণ খাবারে তার আগ্রহ নেই। স্কুলের টিফিনে তেলেভাজা খাবার ছাড়া খায় না; বার্গার, পোলাও, চিকেন ফ্রাই ছাড়া সাধারণ খাবার সে ছুঁয়েই দেখে না। মাঝে মাঝেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়, কিন্তু চিকিৎসকের একটাই কথা, আগে ওজন কমাতে হবে। কিন্তু ওর ওজন দিন দিন বেড়েই চলেছে।

বড় বড় শপিং মলে, ফাস্ট ফুড রেস্তোরাঁয়, স্কুলগুলোর সামনে এমনকি রাস্তায় নামলেই ইদানিং এরকম অতিরিক্ত ওজনের শিশু চোখে পড়ে। বিশেষ করে শহর এলাকায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থূলতায় আক্রান্ত শিশু কিশোর চোখে পড়ে অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়স ও শারীরিক কাঠামোর তুলনায় অতিমাত্রায় ওজনের (যা ওবেসিটি নামে পরিচিত) কারণে শিশুরা যেমন শৈশবের চঞ্চলতা হারাচ্ছে তেমনি শিশু বয়সেই ভুগছে এ সংক্রান্ত নানারকম অসুখে। তাদের ভবিষ্যত জীবন দাঁড়াচ্ছে মারাত্মক হুমকির মুখে।

আর অস্বাভাবিক এই শারীরিক অবস্থার জন্য বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন বাবা-মায়ের অসচেতনতা, শিশু খাবারে জাংক ফুডের আধিক্য, ভিডিও গেমস-কম্পিউটার বা টিভি দেখার মতো কায়িক পরিশ্রমবিহীন কাজে মগ্ন থাকা এবং শরীরচর্চার অভাবকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওবেসিটি বা স্থুলতা শিশুদের ভয়াবহভবে ঠেলে দিচ্ছে আজীবনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা, হার্টের সমস্যা, চোখের সমস্যা, বাত ও হেপাটাইসিসসহ নানা ঝুঁকিতে পরছে শিশুরা। ইতোমধ্যেই বিষয়টিকে জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন তারা।

ওবেসিটি বা মাত্রাতিরিক্ত ওজন২০১৩ সালে প্রথম বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে স্থূলতার প্রকোপ এবং খাদ্যাভাস ও শারীরিক সক্রিয়তার ধরন শীর্ষক এক জরিপ করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি)। সেখানে দেখা যায়, দেশের শহরাঞ্চলের ১৪ শতাংশ শিশু অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতায় ভুগছে। আর ঢাকায় এর সংখ্যা ২১ শতাংশ।

কম ওজন, স্বাভাবিক ওজন, অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতা-এই চারভাগে ভাগ করা হয় জরিপে। সেখানে দেখা যায়, শহরাঞ্চলে ১০ শতাংশ শিশু অতিরিক্ত ওজনে ভুগছে এবং ৪ শতাংশ শিশু ভুগছে স্থূলতায়। আর ঢাকা মহানগরে এর সংখ্যা যথাক্রমে ১৪ এবং ৭ শতাংশ। স্থূলতা এবং অতিরিক্ত ওজনের শিশুদের ৭০ শতাংশের বয়স ৫ থেকে ১২ বছর এবং বাকি ৩০ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছর। অতিরিক্ত ওজন ও স্থূল শিশুর সংখ্যা শিক্ষিত পরিবারে বেশি বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে।

শিশুদের স্থূলতার বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইফফাত আরা শামসাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমান সময়ে শিশুদের ওবেসিটিকে নতুন এক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখছি আমরা। খুবই আতঙ্কের বিষয় এটি। এখনই যদি আমরা সচেতন না হই তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের খুব ভোগাবে এটা নিশ্চিত।’


অধ্যাপক ইফফাত আরা আরও বলেন, ওবেসিটির প্রধান কারণ শিশুরা মাঠে খেলে না, সারাক্ষণ টিভি দেখে, গেমস খেলে, তাদের শারীরিক পরিশ্রম নেই বললেই চলে। অন্যদিকে রিচফুড, জাঙ্কফুড বেশি খাচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগে শিশুরা ভুগছে শুধুমাত্র এই ওবেসিটির কারণেই।’
অপরদিকে ইউনিসেফে কর্মরত পুষ্টিবিদ ডা. আইরিন আখতার চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাচ্চারা এখন খুব বেশি ফাস্টফুড এবং প্রসেসডফুড (প্রক্রিয়াজাত খাবার) খাচ্ছে। নিম্নমানের চিপস, বিস্কিটের মতো প্রসেসডফুড গ্রামাঞ্চলেও পাওয়া যাচ্ছে। টেস্টিং সল্ট, নিম্নমানের ক্রিম ও মাখনসহ যে ধরনের প্রিজারভেটিভ এসব খাবারে দেওয়া হয় সেগুলো শিশুদের জন্য  খুবই ক্ষতিকর।শরীরের স্বাভাবিক বিকাশে এগুলো সমস্যা তৈরি করে।এই সমস্যা এড়াতে কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ সুষম খাবার এবং ঘরে তৈরি সাধারণ খাবার শিশুদের খেতে দিতে হবে।’
ডা. আইরিন বলেন, ‘এখন বাচ্চারা কাঁদলেই আমরা চিপস, বিস্কুটের প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দেই। এভাবেই আমরা শিশুদের অভ্যাস তৈরি করে ফেলি। পরবর্তীতে শিশুরা নিজেরাই এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।’
শহরে শিশুরা ফাস্টফুড যত খায় তত পরিশ্রম করে না। অতিরিক্ত চর্বি ও মেদ পোড়ানোর জন্য যতটা পরিশ্রম করা দরকার তারা সেই সুযোগ পায় না বা পেলেও পরিশ্রম করে না। এ কারণেও তাদের মধ্যে স্থূলতা বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, ওবেসিটি সমস্যা থেকে উত্তোরণের জন্য শিশুদের আউটডোরে খেলতে দিতে হবে, টেলিভিশন দেখা, মোবাইল ফোনে গেমস খেলা, ভিডিও গেমস খেলার আসক্তি কমাতে হবে, খাবার দাবারে সচেতন হবে। বাড়িতে তৈরি সুষম খাবার খেতে উৎসাহিত করতে হবে।

/এফএস/টিএন/