ফেসবুকেই মেলে ঝটপট জন্মসনদ, জড়িত ডিএনসিসির কর্মীও

জরুরি প্রয়োজনে জন্ম কিংবা মৃত্যু সনদ প্রয়োজন? চিন্তা নেই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সার্চ দিলেই মিলবে সমাধান। শুধু তাই নয়, এক দিনের মধ্যেই দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে মিলবে সনদ, এ জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও দিতে হবে না। তবে গুণতে হবে অতিরিক্ত কিছু অর্থ। আর ফেসবুকে পেজ খুলে এমন ‘মুসকিল আসানের সুযোগ’ দিচ্ছিল একটি চক্র। তাদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) দুই কর্মচারীও। শেষ রক্ষা হয়নি, গ্রেফতার হয়েছে চক্রটির ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।

সংস্থাটি বলছে, আর্থিক সুবিধা নিয়ে চক্রটিকে সহায়তা করতো ডিএনসিসির সনদ নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা কয়েকজন কর্মকর্তাও। তাদের সহযোগিতায় আইডি–পাসওয়ার্ড নিয়ে তথ্য ব্যবস্থাপনার সার্ভারে অবৈধভাবে ঢুকে ভুয়া তথ্য সংবলিত আবেদনপত্রেই সনদ ইস্যু করা হতো। চক্রটি গত ছয় মাসে অন্তত ৩ হাজার ভুয়া জন্ম ও মৃত্যু সনদ ইস্যু করেছে বলেও জানিয়েছে সিআইডি। গত বুধবার (১ মার্চ) এই পাঁচ জনকে গ্রেফতারের পর এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে।

এই চক্রের খপ্পরে পড়া এক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বলেন, ‘বিশেষ প্রয়োজনে আমার বাবা-মায়ের মৃত্যু সনদের প্রয়োজন হয়। এ বিষয়ে আমি আমার পরিচিত একজনের সহযোগিতা চাই। তিনি আমাকে ফেসবুক পেজের তথ্য জানান। পরে তার সহযোগিতায় ওই পেজের অ্যাডমিনের সঙ্গেও যোগাযোগ হয়। তারা দুইটি সনদ প্রস্তুত করতে ফি হিসেবে ৬ হাজার টাকা চায়। আমি প্রথমে তাদের ২ হাজার টাকা দেই। পরে সনদগুলো অনলাইনে চেক করার পর বাকি ৪ হাজার টাকা পেরিশোধ করি। কিন্তু কিছুদিন পর অধিদফতর থেকে একজন ফোন করে বলেন, আমার সনদগুলো অবৈধভাবে তৈরি করা হয়েছে। এখন এগুলো আদৌও চলবে কি না, জানি না।’

এ প্রসঙ্গে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন অধিদফতরের রেজিস্ট্রার জেনারেল (অতিরিক্ত সচিব) মো. রাশেদুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের তথ্য ব্যবস্থাপনার সার্ভারে হঠাৎ তথ্যের গড়মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অবৈধ উপায়ে কে বা কারা জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সার্ভারে অনুপ্রবেশ করে সনদ তৈরি করছে, প্রযুক্তির সাহায্যে এমন তথ্য ধরা পড়ে। পরিবর্তি সময়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে জরুরি ভিত্তিতে অধিদফতরের অন্যান্যদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আমরা বিষয়টি সিআইডিকে জানাই।

সিআইডি জানায়, গত ৭ ফেব্রুয়ারি জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন অধিদফতরের রেজিস্ট্রার জেনারেল রাশেদুল ইসলাম সিআইডিতে একটি চিঠি পাঠান। ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, অবৈধ উপায়ে কেউ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সার্ভারে অনুপ্রবেশ করে সনদ তৈরি করছে। তাদের চিহ্নিত করা ও আইনগত ব্যবস্থা নিতে তিনি সিআইডিকে অনুরোধ জানান। এরপর সিআইডির প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়ার নির্দেশনায় সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি) এই বিষয়ে অনুসন্ধান চালায়।

কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তাদের কাছ থেকে ‘জন্ম নিবন্ধন হেল্প ডেস্ক’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপের সন্ধান পাওয়া যায়। যেখানে ফেসবুকে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বলা হয়েছে, মাত্র একদিনে দেশের যে কোনও জেলার জন্ম ও মৃত্যু সনদ সংগ্রহ করুন। সাইবার পুলিশ সেন্টার ওই গ্রুপের অ্যাডমিনসহ চক্রটিকে শনাক্ত করে।

এরই ভিত্তিতে প্রথমে, ভুয়া জন্ম ও মৃত্যু সনদ তৈরিতে জড়িত ফেসবুক গ্রুপের অ্যাডমিন মাহবুব আলী ও শাহ আলমকে রাজধানীর পল্লবী থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ডিএনসিসির অঞ্চল-৪–এর স্প্রেম্যান হাসান তারেক ও ভ্যাকসিনেটর কোহিনুর সুলতানাকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া জন্ম নিবন্ধনের জন্য ভুয়া কাগজপত্রসহ ফাইল জমা দিতে আসা মো. ফয়সাল নামে আরেকজনকে গ্রেফতার করে। তারা সবই এ চক্রের সক্রিয় সদস্য বলে জানিয়েছে সিআইডি।

বুধবার গ্রেফতার পাঁচ জন

এসময় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে বেশ কিছু ভুয়া জন্ম ও মৃত্যু সনদ, সনদ তৈরির ভুয়া কাগজপত্রসহ আটটি ফাইল, তিনটি হার্ডডিস্ক ও চারটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। 

গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে সিআইডি জানায়, মূলত ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার কাজটি করতো মাহবুব আলী ও শাহ আলম। এর মাধ্যমে সারা দেশ থেকে গ্রাহক সংগ্রহ করতো তারা। গ্রেফতার আরেক আসামি ফয়সাল কম্পিউটার কম্পোজের দোকান চালায়। তার দোকানে নিয়মিতই জন্ম ও মৃত্যু সনদ নিবন্ধন করতে আসেন গ্রাহকরা। তাদের দেওয়া তথ্যের তথ্যের সঙ্গে ভুয়া তথ্য সংযোজন করে জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরির ফাইল বানাতো সে। সেই ফাইল জমা দিতো ডিএনসিসির ওই দুই কর্মচারীর কাছে। 

এমন ফাইল তৈরির জন্য প্রত্যেক গ্রাহকের কাছ থেকে ৫৫০ থেকে ১ হাজার টাকা করে নিতো চক্রটি। যেখানে জন্ম নিবন্ধনের সরকারি ফি ৫০ টাকা।

এ প্রসঙ্গে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) কর্মকর্তা বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রেজাউল মাসুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই কাজে চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন জেলার আগ্রহীদের আবেদনের সঙ্গে ডিএনসিসি এলাকার একটি বিদ্যুৎ বিলের কাগজ যুক্ত করে দিতো। অনেক ক্ষেত্রে মিরপুরের একটি স্কুলের প্রশংসাপত্রও ব্যবহার করতো তারা। ফটোশপে প্রশংসাপত্র এডিট করে মূল শিক্ষার্থীর নাম ও পিতার নাম পরিবর্তন করে দিতো তারা। এক্ষেত্রে একই রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বরের কাগজ একাধিক আবেদনের সঙ্গে যুক্ত করে দিতো তারা। কোনও যাচাই-বাছাই ছাড়াই এই চক্রের সদস্যরা জন্ম সনদ বের করে আনতো।

এই সিআইডি কর্মকর্তা জানান, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সনদ প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিবেচনা করা হয়; জন্মস্থান, স্থায়ী ঠিকানা এবং বর্তমান ঠিকানা। এসব বিষয় বিবেচনা না করেই তারা অবৈধভাবে সনদ প্রস্তুত করতো। ডিএনসিসির যে কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় চক্রটি এই জন্ম ও মৃত্যু সনদ করতো, তাদেরও শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে চেষ্টা অব্যহত আছে বলেও জানান তিনি।