লোকাল বাস এবং একজন অনামির গল্প

‘এই খামারবাড়ি, আসাদগেট, ধানমন্ডি, কলাবাগান...ওঠেন ওঠেন...’ ডাকতে থাকা বাসে উঠতে গেলে, ‘মহিলা উইঠেন না, আপনের জায়গায় আরও দুইজন লোক নিতে পারমু’ শুনে রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকেন অনামি। তার সঙ্গে রাস্তায় এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন নানা বয়সী বেশ কয়েকজন নারী। কোনোরকমে একটা বাসে ওঠার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

এদিকে অফিসের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। আজ আবারও দেরি হবে অফিসে যেতে, চিন্তা করেই অনামির মুখে ফুটে উঠলো বিষণ্ণতার ছাপ।

সদ্য অনার্স পাস করে একটা করপোরেট অফিসে চাকরি শুরু করেছেন অনামি। মিরপুর থেকে প্রতিদিন ধানমন্ডি যেতে হয় তাকে। সামান্য বেতনে দিব্যি হাত খরচ চলে যায়। তবে যাতায়াতের জন্য লোকাল বাসই তার ভরসা। প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় বাসে ওঠা যেন অনামির সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

এমনিতেই অফিস টাইম, বাসভর্তি লোক। আর কোনও বাসে যদি একটু দাঁড়াবার জায়গা থেকেও থাকে, নারী যাত্রীদের তুলতে নারাজ থাকেন বাস চালকেরা। কষ্ট করে হলেও বেশিরভাগ দিনই ধাক্কাধাক্কি করে কোনোভাবে বাসে উঠে পড়েন তিনি। কিন্তু বাসে উঠে পড়লেই যে ঝামেলার সমাপ্তি, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। বাসে উঠে শুরু হয় তার নতুন লড়াই। সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বুঝতে পারেন— বাসে বসে থাকা যাত্রীদের চোখ তার দিকে। কেউ আবার ভিড়ের দোহাই দিয়ে গায়ের সঙ্গে যথাসম্ভব ঘেঁষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। সিটে বসলেও আছে বিপত্তি।

সিটে বসতে পারলেও পাশের সিটের সহযাত্রী একজন পুরুষ, তাই সচেতনভাবে গুটিসুটি মেরে বসতে হয়। চাপা সিটের অনেকটা অংশজুড়ে বসে বা দুই পা ছড়িয়ে জায়গা সংকুচিত করে অস্বস্তি তৈরি করার প্রবণতা পুরুষ যাত্রীদের নিত্য দিনের। কাউকে একটু সরে বসার বা দাঁড়ানোর অনুরোধ করা হলে পাল্টা শুনতে হয়, ‘এত সমস্যা থাকলে লোকাল বাসে ওঠেন কেন?’ লোকাল বাসে যাতায়াত করা হাজারো নারী ও মেয়েদের গল্পও এই একই রকমের।

ঢাকা শহরে গণপরিবহন, বিশেষ করে লোকাল বাসের খারাপ অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী বলেন, ‘বার্ষিক পরীক্ষা দিতে বাসে করে স্কুলে যাচ্ছিলাম। সিটে বসে পরীক্ষার আগে শেষবারের মতো মনোযোগ দিয়ে বইয়ের পাতায় একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। এমন সময় আমার পাশের এক লোকের হাত আমার শরীরে অনুভব করি। ব্যথায় আঁতকে উঠে যখন চিৎকার করে অন্য যাত্রীদের বললাম— এই লোকটা আমার গায়ে হাত দিচ্ছে, তখন নীরব দর্শকের মতো সবাই শুধু চেয়ে দেখলো। আর লোকটা অনায়াসে নেমে গেলো বাস থেকে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী নাফিসা শারমিলি বলেন, ‘চেষ্টা করি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চলাফেরা করতে। লোকাল বাসে উঠলে বাজে উদ্দেশ্য নিয়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করতে চায় লোকজন। মধ্যবয়সী লোকজনের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখি।’

আরও কয়েকজন নারী যাত্রীও লোকাল বাসে যাতায়াতের অভিজ্ঞতায় বিভিন্ন ভোগান্তি, বিড়ম্বনা ও হয়রানির কথা জানিয়েছেন। এসব অভিযোগ ও হয়রানি নিয়ে মাঝে মধ্যে আলোচনা হলেও তার দৃশ্যমান কোনও সমাধান হয়নি।

এমন হয়রানির সমাধান জানতে চাইলে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘কর্মজীবী নারী’র প্রকল্প সমন্বয়ক ফারহানা আফরিন তিথি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে নারীদের জন্য যে বিআরটিসি বাস দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর সংখ্যা আরও বাড়ানো উচিত। বাড়ানো উচিত বাস রুটের সংখ্যা।’ তিনি মনে করেন, গণপরিবহনের প্রতিটি রুটে নারীদের জন্য অন্তত পাঁচটি বাস থাকা উচিত।

হয়রানির কারণ হিসেবে যাত্রীদের মধ্যে নারীদের প্রতি সম্মানবোধের অভাব ও যথাযথ আইনের অভাবের কথা উল্লেখ করেন নারী অধিকার সংগঠক খুশি কবির।  নারীদের এমন ভোগান্তি কমানোর উপায় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গণপরিবহনে নারী হয়রানির জন্য আইন প্রণয়ন ও সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ হওয়া প্রয়োজন। লোকাল বাসে এমন হয়রানি হলে অপরাধীর পাশাপাশি বাসের চালক, কনডাক্টর ও হেলপারদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে— যাতে তারা এই বিষয়ে সতর্ক থাকে। বাস থেকে নেমে কাছের পুলিশ বক্সে কোনও নারী অভিযোগ করলে— সত্যতা যাচাই করে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে।’