পুলিশের চাকরি নারীর নয়, এই ধারণা পাল্টে দিয়েছেন তারা

পুলিশের পেশা অনেকে ক্ষেত্রেই ঝুঁকিপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নানা কারণে সেটা নারীদের জন্য আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করা হতো। তবে এই ধারণা ভেঙে দিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের নারী সদস্যরা। ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান পরিচালনা থেকে শুরু করে চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উন্মোচনসহ পুলিশের সর্বত্র সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তারা দক্ষতার প্রমাণ রেখে সুনাম অর্জন করছেন।

১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ উদ্যোগে ১৪ জন নারীর যোগদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশে নারীদের পথচলা শুরু। বর্তমানে দেশের পুলিশ বাহিনীতে বিভিন্ন ইউনিটে বিভিন্ন পদে ১৫ হাজার ৫১৬ জন নারী কাজ করছেন, যা পুরো পুলিশ বাহিনীর সদস্যের আট ভাগের বেশি (৮ দশমিক ১৮ শতাংশ)।

পুলিশ সদর দফতরের ইউএন ডেস্কের গত ১ ফেব্রুয়ারির (২০২৩) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করছেন ১৫১ জন নারী সদস্য। জাতিসংঘ সদর দফতর, কঙ্গো, মালি, দারফুরসহ বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন তারা। মিশনগুলোতে স্থানীয় নারী ও শিশুদের আপন করে নেওয়ার ক্ষেত্রে নারী পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে।

পুলিশিং সেবা বেছে নিয়েছেন নার্গিস আক্তার ঝরা। রাজধানীর কলাবাগান থানায় উপপরিদর্শক হিসেবে কর্মরত তিনি। ঝরা জানান, প্রথাগত ধারণা ভেঙে একজন নারীও যে রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালনে যেকোনও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারেন, সেটা তিনিসহ অসংখ্য নারী পুলিশ সদস্য দেখিয়েছেন। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছে।

পুলিশে সার্জেন্ট হিসেবে নারীদের অন্তর্ভুক্তি বেশি দিনের নয়। ২০১৪ সালে এই সার্জেন্ট নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর ২০১৫ সালের দিকে সার্জেন্ট পদে নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেই পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ২৮ জন নারী সার্জেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদেরই একজন হাসিনা বেগম। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগে কাজ করছেন শুরু থেকেই। ভোরে ঘুম থেকে উঠে পরিবারের নানা কাজ করেন। পরে ছুটে যান রাস্তায়, ট্রাফিকের দায়িত্ব পালনে। বর্তমানে মোহাম্মদপুর ট্রাফিক জোনে কর্মরত এই নারী পুলিশ সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আসাদগেট, গণভবন, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড ও শ্যামলীসহ আশপাশের সিগন্যালগুলোতে রুটিন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

হাসিনা বেগম বলেন, নারী সার্জেন্ট দেখলে প্রথমে অনেকেই গুরুত্ব দিতে চায় না। ট্রাফিক আইন ভঙ্গের অভিযোগে মামলা দিতে গেলে অনেক চালকই তখন নানাজনকে ফোন করে, ক্ষমতা দেখাতে চায়। তবে যখন বুঝতে পারে এসব করে পার পাওয়া যাবে না, তখন অনুনয় বিনয় শুরু করে। নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

সাবিনা ইয়াসমিন ডিএমপির পুলিশ সার্জেন্টদের একজন। ২০১৭ সালে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পুলিশে যোগ দেন তিনি। এরপর থেকে ডিএমপির মতিঝিল ট্রাফিক বিভাগে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন সাবিনা।

পুলিশ সদর দফতরের অক্টোবর ২০২২-এর জনবল প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পুলিশ বাহিনীতে এক লাখ ৮৯ হাজার ৫৬০ জন সদস্য কর্মরত রয়েছেন। এরমধ্যে অতিরিক্ত আইজিপি পদে কোনও নারী নেই। গ্রেড-৩-এ ডিআইজি পদে নারী আছেন চার জন। গ্রেড-৪-এ অ্যাডিশনাল ডিআইজি পদে নারী আছেন ২৩ জন। গ্রেড-৫-এ পুলিশ সুপার পদে নারী আছেন ৬৫ জন। গ্রেড-৬-এ অ্যাডিশনাল পুলিশ সুপার পদে আছেন ১২১ জন নারী। গ্রেড-৯-এ সহকারী পুলিশ সুপার পদে নারী আছেন ৮১ জন।

গ্রেড-৯-এ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) হিসেবে আছেন ১১৩ জন নারী। গ্রেড-১০-এ সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) পদে আছে ৮৪৯ জন নারী। গ্রেড-১০-এ সার্জেন্ট পদে নারী আছেন ৫৮ জন। গ্রেড-১৪-তে এএসআই পদে ১৪ জন নারী কাজ করছেন। গ্রেড-১৫-তে নায়েক পদে আছেন ৩০৬ জন নারী। কনস্টেবল পদে কাজ করছেন ১২ হাজার ৭৪৩ জন নারী।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) লালবাগ বিভাগের উপ- কমিশনার (ট্রাফিক) আসমা সিদ্দিকা মিলি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পুলিশে চ্যালেঞ্জ আছে জেনেই আমরা এ পেশায় যোগ দিয়েছি। তবে নারী হওয়ার কারণে কখনোই কোনও সমস্যার মুখোমুখি হইনি। শুধু নারী পুলিশ নয়, যেকোনও পুলিশ সদস্য যদি কর্মক্ষেত্রে গিয়ে সমস্যায় পড়ে, সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়।

তিনি বলেন, একজনকে পাশের সহকর্মীরা সাপোর্ট দিলেই আর কিছু দরকার হয় না। নারী পুলিশ অফিসার হিসেবে আমি আমার ফোর্সের নারী সদস্যদের সেটাই নির্দেশনা দিয়ে আসছি। নারীদের শুধু পাশে থেকে সাহস দিলে, তাদের দিয়ে অনেক কাজ করা সম্ভব। এছাড়া একজন নারী পুলিশ অফিসার শুধু নির্ভরতার জায়গা চায়। সেটা পেলে আর কোনও সমস্যা হওয়ার কথা না।