রমজানে যেসব হাফেজ তারাবি পড়াবেন না, তাদের করণীয় কী

পবিত্র রমজান মাসে কোরআনের হাফেজরা মসজিদগুলোয় খতম তারাবির ইমামতি করেন। নামাজে কোরআন তিলাওয়াত অনেক সওয়াবের কাজ। এ লক্ষ্যেই হাফেজরা রমজানে খতম তারাবি পড়েন। বড় এ উদ্দেশ্যের পাশাপাশি তারাবি পড়ার পেছনে আরও কিছু ছোট কারণও থাকে। সেগুলোর একটি হলো– সারা বছর ব্যস্ত থাকা হাফেজরা যেন অন্তত পবিত্র এই মাসে তারাবি উপলক্ষে কোরআনে কারিম বেশি বেশি তিলাওয়াত করতে পারেন। এতে তাদের কোরআন ইয়াদ (স্মরণ) মজবুত হয়।

তবে এ ক্ষেত্রে অনেক হাফেজকে দেখা গেছে তারাবি পড়ানোতে ইয়াদ রাখার ব্যাপারটিই বরং তাদের কাছে মুখ্য।

হাফেজরা মনে করেন, যদি রমজানে তারাবি পড়ানো হয়, তাহলে সারা বছর তিলাওয়াত কম করলে কিংবা না করলেও কোরআনে কারিম ইয়াদ (মুখস্থ) রাখতে কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু একজন হাফেজ মুখস্থ রাখার জন্যই তারাবি পড়াবেন–এটি সমীচীন নয় বলে জানাচ্ছেন গবেষক মুফতি মানসুর আহমাদ।

মুফতি মানসুর রাজধানীর প্রসিদ্ধ ইসলামী বিদ্যাপীঠ জামিয়া আরাবিয়া বাইতুস সালামের (বাইতুস সালাম মাদ্রাসা) অধ্যক্ষ ও মেঘনা গ্রুপ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব। তার মতে, মুখস্থ রাখার জন্য তারাবিকেই একমাত্র মাধ্যম বানানো অনুচিত। কোরআন মুখস্থ রাখতে এরূপ নিচে নেমে আসা একজন হাফেজের জন্য সমীচীন নয়।

এ প্রসঙ্গে মুফতি মানসুর বলেন, ‘হাফেজের মর্যাদার কথা আমরা সবাই জানি ও বিশ্বাস করি। এটা স্বীকৃত বিষয় যে কোনও উচ্চ মর্যাদার সঙ্গে উচ্চ দায়িত্বের ব্যাপার থাকে। একজন কোরআনের হাফেজ অন্যদের চেয়ে যেমন বেশি সম্মানিত, তেমনি তার দায়িত্বও বেশি। আর সাধারণ মানুষের চেয়ে একজন হাফেজকে নামাজের মধ্যে কোরআন বেশি তিলাওয়াত করতে হবে, এটা সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত।’

হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে মানসুর আহমাদ বলেন, ‘রাসুল (সা.) নিজে, সাহাবায়ে কেরাম ও আমাদের সালাফরা নামাজ লম্বা করতেন। তারা সালাতে লম্বা লম্বা কিরাত পড়তেন। তো এ হিসাবে বোঝা যাচ্ছে যে হাফেজের দায়িত্ব হচ্ছে কোরআন তিলাওয়াত লম্বা সময় নিয়ে করবেন এবং নামাজের মধ্যে করবেন। সারা বছর করবেন; দিনেও করবেন, রাতেও করবেন।’

এই ইসলামি গবেষকের দাবি, হাদিসে বর্ণিত পদ্ধতি যদি একজন হাফেজ অনুসরণ করেন, মানে সারা বছর যদি তিনি নিয়মিত নামাজে কোরআন তিলাওয়াত করেন, তাহলে তার শুধু মুখস্থ রাখার উদ্দেশে তারাবি পড়াতে হবে না। এ ক্ষেত্রে হাফেজদের চিন্তা-চেতনা আরও পরিণত হতে হবে বলে মত দিয়েছেন তিনি।

মানসুর আহমাদ বলেন, ‘একজন হাফেজের শুধু মুখস্থ রাখার চিন্তা থাকা উচিত নয়; বরং আরও উচ্চ চিন্তা করতে হবে। একজন পার্থিব উচ্চপদস্থ মানুষ যদি চিন্তা করে–চেয়ারটা কীভাবে টিকিয়ে রাখা যায়, তাহলে এটা তো তার দায়িত্বশীলতা হলো না। তিনি তো তার দায়িত্বের হক আদায় করতে থাকবেন। চেয়ার ও মর্যাদা তো এমনিতেই টিকে থাকবে। কোরআনের হাফেজের ক্ষেত্রেও ঠিক একই কথা। মানে তিনি যদি কোরআনের হক আদায় করেন, তাহলে তার মুখস্থ আপনা-আপনিই ঠিক থাকবে।

পবিত্র কোরআন মুখস্থ রাখার ক্ষেত্রে সারা বছর নামাজের তিলাওয়াতকে সর্বোত্তম পদ্ধতি আখ্যায়িত করেছেন বিশিষ্ট এ ইসলামি স্কলার।

হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে এই মুফতি বলেন, ‘রাসুল (সা.) মুসলিম শরিফের ৭৮৯ নম্বর হাদিসে বলেছেন, ‘কোরআনের হাফেজ যখন নামাজ পড়ে এবং দিনরাতে নামাজের মধ্যে তিলাওয়াত করে, সে কোরআন ইয়াদ রাখতে সক্ষম হবে। আর যদি সে নামাজে তিলাওয়াত না করে, তাহলে সে ভুলে যাবে।’ এখানে তো রাসুল (সা.) সারা বছরই দিন-রাত সব সময় তিলাওয়াতের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। কোরআন মুখস্থ রাখার উপায় এখানে বলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের এখানে ফিরে আসা দরকার।’

প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে মানসুর আহমাদ বলেন, ‘আজকাল আমাদের মধ্যে আমূল পরিবর্তন এসেছে– হাফেজ, গাইরে হাফেজ; আলেম, গাইরে আলেম— সবার মধ্যেই নামাজ লম্বা করার প্রবণতা শুধু জামাতে। পক্ষান্তরে ব্যক্তিগত নামাজ খুব কম সময়ে সেরে ফেলি। অথচ সুন্নাহ ও সালাফের আমল হচ্ছে, ব্যক্তিগত নামাজ লম্বা হবে জামাতের নামাজের তুলনায়। অর্থাৎ জামাতের নামাজে যদি চার রাকাতে ১০ মিনিট লাগে, তাহলে ব্যক্তিগত নামাজে আরও বেশি লাগবে। আমাদের আসলে মূল জায়গায় ফিরে আসা দরকার। তাহলে এসব বিষয় নিয়ে; বিশেষ করে তারাবি ছুটে গেলে পেরেশানিতে পড়তে হবে না।’

হাফেজেদের উদ্দেশে পরামর্শ দিয়ে মুফতি মানসুর আহমাদ বলেন, ‘কারও যদি তারাবির ব্যবস্থা মসজিদে না হয়, তাহলে ঘরে সেটার ব্যবস্থা হতে পারে। দু-চারজন মুসল্লি নিয়েই তা সম্ভব। এটাও যদি সম্ভব না হয়, তাহলে একাকী পড়বে। কেননা, তারাবির জামাত হচ্ছে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া। সে জন্য মুখস্থ রাখার স্বার্থে পরিস্থিতি বিবেচনায় হাফেজ একাকীও লম্বা কেরাতে তারাবি পড়তে পারেন।’

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী; শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা।